গল্প

একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর
মিতুল ও তার রবোট
গো-গো গোল্ডেন ফাইভ
লুডো টুর্নামেন্ট
ফিরে এলো ছোটাচ্চু
জাল নোট
এক সেট গয়না

একটা মাছের গল্প


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

শাহেদ আর শংকর দুইজন খুব বন্ধু। তারা এক গ্রামে থাকে, এক স্কুলের এক ক্লাশে পড়ে, এক সাথে খেলে তারপর একসাথে সমুদ্রের তীরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের দুজনেরই বাবা কাকারা বড় বড় নৌকা করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। কখনো এক সপ্তাহ কখনো দুই সপ্তাহ সমুদ্রে মাছ ধরে তারা তাদের বড় বড় নৌকা বোঝাই করে মাছ নিয়ে আসে। শাহেদ আর শংকর দুজনেই অপেক্ষা করে আছে কখন তারা বড় হবে আর কখন তারাও তাদের বাবা কাকাদের মত সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে।
শাহেদ আর শংকরের বাবারা তাদেরকে বলেছে তারা যদি ভালো ছেলে হয়ে থাকে, নিয়মিত লেখাপড়া করে তাহলে একবার তাদেরকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে। তারা তখন দেখবে সমুদ্রে তাদের বাবা কাকারা কেমন করে বড় বড় জাল ফেলে মাছ ধরে, কেমন করে জাল টেনে সেই মাছ নৌকায় তুলে, কেমন করে তারা নৌকাতে রান্না করে খায় কেমন করে সেখানে ঘুমায়। শাহেদ আর শংকর দুজনেরই খুবই নৌকায় করে সমুদ্রে যাবার শখ তাই তারা দুজনেই খুব ভালো ছেলে হয়ে থাকে, দুজনেই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে।
একদিন সকালে তারা সমুদ্রের পাড়ে গিয়েছে, তাদের গ্রামের জেলেরা সমুদ্রে যাওয়ার জন্য তাদের নৌকাগুলোতে মালপত্র তুলছে, বড় বড় জালগুলো পরীক্ষা করছে তখন তারা দেখল সাদা হাঁসের মত সুন্দর একটা স্পীডবোট এসে থামল। সেই স্পীড বোট থেকে কয়েকজন মানুষ সমুদ্র তীরে নেমেছে। তাদের কাছে নানা রকম যন্ত্রপাতি, সেগুলো দিয়ে তারা কী যেন করতে থাকল। শাহেদ আর শংকর কাছে থেকে তাদের দেখতে গেল, দেখল এই মানুষগুলোর মাঝে একজন মেয়েও আছে। মেয়েটি তাদের দেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তোমরা বুঝি এই গ্রামে থাক?”
শাহেদ আর শংকর মাথা নাড়ল। মেয়েটা তখন বলল, “জান, তোমাদের দেখে আমার খুব হিংসা হয়।”
শাহেদ জিজ্ঞেস কলল, “কেন? হিংসা হয় কেন?”
“তোমরা কী সুন্দর সমুদ্রের পাড়ে একটা গ্রামে থাক। ঘর থেকে বের হলেই কী সুন্দর সমুদ্রটাকে দেখতে পারো। বাতাসটা কতো ভালো, কোনো ধূলাবালি নেই ধোঁয়ার গন্ধ নেই। কোনো গাড়ীর শব্দ নেই। কী মজা!”
শংকর জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় থাকেন?”
“আমি অনেক দূরের দেশে থাকি। দেশটার নাম আমেরিকা।”
শাহেদ জিজ্ঞেস করল, “আপনি বুঝি এখানে মাছ ধরতে এসেছেন?”
মেয়েটা হেসে ফেলল, বলল, “না, মাছ ধরতে নয়! মাছ দেখেতে এসেছি!”
শাহেদ বলল, “হ্যাঁ, আমাদের এখানে অনেক মাছ আছে, আপনি সবরকম মাছ দেখতে পারবেন!”
মেয়েটা বলল, “আমি আর আমার টিমের সবাই অবশ্য সবরকম মাছ দেখতে আসিনি। নির্দিষ্ট একটা মাছ দেখতে এসেছি।”
“কী মাছ?”
“এটাকে করাত মাছ বলে। এদের মাথায় এরকম লম্বা একটা করাতের মত থাকে।”
শাহেদ আর শংকর দুজনই বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমরা এই মাছটা দেখেছি। একবার আমাদের গ্রামের একজন জেলে সেই মাছটা ধরেছিল, বিশাল বড় একটা মাছ! তারপর তার করাতটা কেটে অনেক টাকা দিয়ে বিক্রি করেছে।”
মেয়েটা চোখে মুখে তখন কেমন জানি দুঃখের ছায়া পড়ল। সে বলল, “ইশ!”
শংকর জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“তোমরাও চিন্তাও করতে পারবে না এই মাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কতো চেষ্টা করছে!”
“কেন?”
“এই মাছগুলো পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের সমুদ্রে এখনো এগুলো পাওয়া যায়। সেই জন্য কতদূর থেকে এসেছি দেখার জন্য, করাত মাছগুলো কেমন আছে। কতোগুলো আছে। সব জেলেদের বলতে এসেছি, “প্লিজ, প্লিজ এই করাত মাছগুলোকে ধরবেন না! এদের বেঁচে থাকতে দেবেন। সারা পৃথিবীর মাত্র অল্প কয়টা জায়গায় এই মাছগুলো পাওয়া যায় তার মাঝে বাংলাদেশ একটা। আমাদের সবাইকে মিলে মাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
শাহেদ আর শংকর অবাক হয়ে এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা কখনো শুনেনি একটা মাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তারা ধরেই নিয়েছে মাছ ধরে রান্না করে খেতে হয়, না হয় বিক্রি করতে হয়!
শংকর বলল, “কিন্তু করাত মাছ তো অনেক মূল্যবান মাছ। অনেক টাকায় বিক্রি হয়। এটা খেলে অনেক কঠিন অসুখ ভালো হয়ে যায়।”
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। এগুলো শুধু কথার কথা। এই মাছ খেয়ে কোনো অসুখ ভালো হয় না! এটা এক ধরণের হাঙ্গর মাছ, অন্য যে কোনো হাঙ্গর মাছের মত।”
মেয়েটা কিছুক্ষণ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এই পৃথিবীটা কতো সুন্দর দেখেছ? এই সুন্দর পৃথিবীটা শুধু মানুষের জন্য নয়, সব প্রাণীর জন্য। তাই যদি কখনো দেখা যায় একটা প্রাণী পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে তখন পৃথিবীর সব মানুষ মিলে সেই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। সেজন্যে আমরা করাত মাছকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি। একটা করাত মাছকেও যদি বাঁচানো যায় সেটা হবে অনেক বড় একটা ব্যাপার!”
শাহেদ আর শংকর য়ারো বেশি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারা কখনো এই মেয়েটার মত চিন্তা করেনি, কিন্তু মেয়েটা তো ঠিকই বলেছে।
মেয়েটা তাদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে তাদের স্পীডবোটের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গিয়ে শাহেদ আর শংকরকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা ইংরেজি পড়তে পার?”
তারা খুব বেশি ইংরেজি পড়তে পারে না কিন্তু সেটা এখন আর স্বীকার করল না, মাথা নেড়ে বলল, “হ্যা। পারি।”
মেয়েটা বলল, “গুড!” তারপর পিঠের ব্যাগ খুলে সেখান থেকে একটা বই বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও। এই বইটা পড়ে দেখো। তাহলে করাত মাছ নিয়ে সবকিছু জেনে যাবে।”
শাহেদ হাত বাড়িয়ে বইটা নিল, জিজ্ঞেস করল, “আমাদের দিয়ে দিচ্ছেন?”
মেয়েটা হাসল, বলল, “হ্যা, দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা পড়বে।”
শংকর জিজ্ঞেস করল, “আপনার নাম কী আপু?”
“আমার নাম মিলিয়া।” তারপর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইখানে আমার নাম ঠিকানা দেওয়া আছে।”
শংকর হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিল। স্পীডবোট থেকে একজন গলা উচিয়ে ডাকল, “কুইক মিলিয়া। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
মিলিয়া নামের মেয়েটা তখন শাহেদ আর শংকরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাদের স্পীডবোটের দিকে এগিয়ে গেল। স্পীডবোটটা সাদা ফেনার মত ঢেউ তুলে দূরে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত শাহেদ আর শংকর সেটার দিকে তাকিয়ে রইল।
শাহেদ আর শংকর তখন সুন্দর মোটা বইটা নিয়ে একটু কাড়াকাড়ি করল, কিন্তু তারা যেহেতু খুব ভালো বন্ধু তাই ঝগড়া করল না। একটা গাছের নিচে বসে বসে দুইজন মিলে বইটার ছবিগুলো দেখলো। নানা রকম করাত মাছের ছবি, কী সুন্দর সেই ছবিগুলো! পৃথিবীর ম্যাপ এঁকে সেখানো কোথায় কোথায় করাত মাছ পাওয়া যায় সেটা লেখা আছে, তারা ম্যাপে বাংলাদেশ খুঁজে বের করে দেখল সত্যি সত্যি বাংলাদেশের সমুদ্র হচ্ছে করাত মাছের ঘাটি।
শাহেদ আর শংকর দুইজন মিলে বইটা পড়তে শুরু করেছে। অনেক ইংরেজি শব্দের অর্থ জানে না, সেগুলো স্কুলের আপাকে জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিল। তাদের উৎসাহ দেখে আপা তাদেরকে ছোট একটা ডিকশনারী দিয়েছেন, সেটা থেকে তারা প্রত্যেকদিন নূতন নূতন শব্দ শিখতে শুরু করল। আস্তে আস্তে বানান করে করে পড়ে তারা একদিন পুরো বইটা পড়ে শেষ করে ফেলল। সেখান থেকে তারা করাত মাছ সম্পর্কে কতকিছু যে জানল তার আর শেষ নেই। শুধু তাই না, শাহেদ আর শংকর মিলে ঠিক করে ফেলল, যখন বড় হবে তখন তারাওমিলিয়া আপার মত করাত মাছকে রক্ষা করার জন্যে কাজ করবে। সাদা রংয়ের একটা স্পীড বোটে যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবে!

সেই বছর পরীক্ষার ফল বের হলে দেখা গেল শাহেদ আর শংকর দুইজনের পরীক্ষাই ভালো হয়েছে। সবচেয়ে ভালো হয়েছে ইংরেজি পরীক্ষা, সেখানে দুইজনই এ-প্লাস। মিলিয়া আপার ইংরেজি বইটা পড়তে পড়তে দুইজনই অনেক ভালো ইংরেজি শিখে গেছে।
তখন একদিন শাহেদ তার বাবাকে বলল, “বাবা, তুমি বলেছিলে আমি যদি পরীক্ষায় ভালো করি তাহলে তুমি আমাকে সমুদ্রে মাছ ধরতে নিয়ে যাবে।”
“পরীক্ষায় তুই ভালো করেছিস?”
“হ্যাঁ বাবা। ইংরেজিতে ক্লাশের মাঝে সবচেয়ে ভালো।”
বাবা খুশি হয়ে বললেন, “হ্যাঁ বাবা, ভালো করে লেখাপড়া কর। তারপর আই এ বি এ পাশ করে একটা ভালো চাকরী করবি। তখন আমাদের সংসারেও আর কষ্ট থাকবে না।”
“ঠিক আছে বাবা। কিন্তু এখন আমাকে সমুদ্রে মাছ ধরতে নিবে না?”
মা বলল, “তুই ছোট ছেলে সমুদ্রে কীভাবে যাবি? সমুদ্রে কতো ঢেউ জানিস? কতো রকম বিপদ আপদ, কত পরিশ্রম।”
শাহেদ বলল, “কিছু হবে না মা, আমি পারব।”
মা বললেন, “আরো বড় হয়ে নে, তখন যাবি।”
শাহেদ বলল, “আমি বড় হয়েছি মা। অনেক বড় হয়েছি। বাবা আমাকে কথা দিয়েছিল আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে।”
বাবা শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন। শাহেদের আনন্দ তখন কে দেখে!
শাহেদের বাবা রাজী হয়েছেন দেখে শংকরের বাবাও রাজী হলেন। ঠিক হল, এর পরের বার যখন তারা মাছ ধরতে সমুদ্রে যাবে তখন শাহেদ আরা শংকরকে নিয়ে যাবে।

ওরা দুইজন তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে, দিন যেন আর কাটে না!
শেষ পর্যন্ত একদিন সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার দিনটি চলে এল। শাহেদ আর শংকরের উৎসাহের কোনো শেষ নেই। তারা দুইজনই ছোট ছোট একটা করে ব্যাগ নিয়েছে। সেই ব্যাগে তাদের একটা বাড়তি সার্ট আর প্যান্ট, একটা গামছা, একটি প্লাস্টিকের মগ, একটি খাতা আর পেন্সিল। তারা ঠিক করেছে প্রত্যেকদিন কী হয় সেটা তারা তাদের খাতায় লিখে রাখবে।
এবারে যখন শংকর আর শাহেদও নৌকা করে সমুদ্রে রওনা দিয়েছে তখন তাদের মা আর বোনেরাও সমুদ্রের ঘাটে এসেছে। শাহেদের মা বললেন, “সাবধানে থাকবি বাবা, দুষ্টুমি করবি না।”
“করব না মা। আমরা কখনো দুষ্টুমি করি না।”
শংকরের মা বললেন, “তোদের বাবা কাকারা যেটা বলে সেটা শুনবি।”
“শুনব মা।”
“পেট ভরে খাবি।”
“খাব মা।”
তারপর একজন জেলে ইঞ্জিন চালু করে নৌকা ছেড়ে দিল। শাহেদ আর শংকর নৌকার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে, দেখতে দেখতে তাদের গ্রামটা আস্তে আস্তে ছোট হতে লাগল। ওরা ভেবেছিল বুঝি অনেক বড় বড় ঢেউ হবে কিন্তু সেরকম ঢেউ হলো না। নৌকাটা পানি কেটে কেটে দুলতে দুলতে যেতে থাকে। কী সুন্দর নীলচে সমুদ্রের পানি, আকাশটা আরও নীল, তার মাঝে সাদা মেঘ। ট্রলারের পিছনে পিছনে অনেকগুলো গাংচিল উড়ছিল এখন সেগুলো চলে গেছে। শাহেদ আর শংকর ট্রলারের ছাদে বসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। সব জেলেরা বসে বসে তাদের বিশাল জালটা পরীক্ষা করে দেখছে, সমুদ্রের পানির দিকে তাকাচ্ছে, নিজেদের ভেতর কথা বলছে। নৌকার এক কোনায় একজন চূলা জ্বালিয়ে রান্না বসিয়েছে। অনেক দূরে দূরে অন্য নৌকাগুলোকে দেখা যাচ্ছে, সবগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মাঝে মাঝে চিৎকার করে এক নৌকা অন্য নৌকাকে ডেকে কিছু একটা বলছে।
পরদিন জাল ফেলা হল। জাল ফেলতে ফেলতে নৌকাটা আস্তে আস্তে যাচ্ছে, কতো লম্বা জাল, ফেলছে তো ফেলছেই সেটা যেন আর শেষ হয় না। জাল ফেলার পর সবাই খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে তাদের আসল কাজ শুরু করল, সেটা হচ্ছে জাল টেনে তোলা। এই সময়টা খুব উত্তেজনার—জালে কতো মাছ ধরা পড়বে সেটা নিয়ে উত্তেজনা। প্রথম দিকে কিছু নেই দেখে শাহেদ আর শংকরের একটু মন খারাপ হচ্ছিল, হঠাৎ দেখল জালে শুধু মাছ আর মাছ! ছোট মাছ, বড় মাছ, রূপালী মাছ, বাদামি মাছ, লম্বা মাছ, চ্যাপটা মাছ, সূর্যের আলোতে সেগুলো চক চক করছে, পানির উপরে উঠে ছটফট করছে। জাল টেনে সেই মাছগুলো নৌকার পাটাতনে তুলতে লাগল, মাছগুলো সেখানে নড়তে লাগল, লাফাতে লাগলো, ঝাপাতে লাগল। শাহেদ আর শংকরের মুখে হাসি আর ধরে না। জালে এতো মাছ যে মনে হতে থাকে সবাই মিলে টেনেও বুঝি সেই জাল আর তুলতে পারে না! শাহেদ আর শংকরও হাত লাগালো, তাই দেখে সবাই হাসতে থাকে।
শংকরের বাবা বললেন, “আমাদের শংকর আর শাহেদের পয়া খুব ভালা—আজকে এসেছে তাই কতো মাছ ধরা পড়েছে!”
শাহেদের বাবা বললেন, “ঠিকই বলেছ দাদা। এখন থেকে প্রত্যেকবার তাদের নিয়ে আসতে হবে!”
শাহেদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “হ্যাঁ বাবা, হ্যাঁ। প্রত্যেকবার আসব। প্রত্যেক বার।”
বাবা বললেন, “আর লেখাপড়া? সেগুলো শেষ?”
“যখন স্কুল বন্ধ থাকবে তখন।”
শংকরের বাবা জাল টানতে টানতে বললেন, “বাবা আমাদের জীবনটা চোখে দেখছো না? কতো কঠিন। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না খেয়ে জাল টেনে সংসার চালিয়েছি। তোমাদের জীবনটা হতে হবে আমাদের থেকে ভালো। তোমরা ডাক্তার হবে, জজ ব্যারিস্টার হবে, অফিসার হবে—”
শাহেদ মনে মনে ভাবল, জজ ব্যারিস্টার অফিসার হওয়া থেকে সমুদ্রে মাছ ধরাই অনেক ভালো। কিন্তু মুখে বলল, “জী কাকা! জী।”
হঠাৎ জালে ভীষণ ঝটপটের শব্দ হল। মনে হল অনেক বড় একটা মাছ ধরা পড়েছে—জাল টেনে তোলা যাচ্ছে না, সবাই উবু হয়ে তাকাল, তারপর জাল ধরে সাবধানে টেনে তুলতে লাগল, প্রচণ্ড ছটফট করে পানি তোলপার করতে থাকে অনেক বড় একটা মাছ।
শাহেদ আর শংকর নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, জালটা টেনে আরেকটু উপরে তোলার পর তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল, জালে অসহায়ভাবে আটকে আছে বিশাল একটা করাত মাছ!
নিজের অজান্তেই শাহেদ আর শংকর চিৎকার করে উঠল, “না—না—না—”
শাহেদের বাবা অবাক হয়ে বললেন, “না? কী না বাবা?”
“ছেড়ে দাও—ছেড়ে দাও—এই করাত মাছটাকে ছেড়ে দাও!”
শাহেদের বাবা বললেন, “ছেড়ে দেব? এই করাত মাছটাকে ছেড়ে দেব।”
“হ্যাঁ বাবা, হ্যাঁ।”
শংকর বলল, “সারা পৃথিবীতে এই করাত মাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও আর পাওয়া যায় না! বাংলাদেশে এখনো অল্প কয়েকটা আছে।”
শাহেদের বাবা বললেন, “আছে তো ভাল। এই জন্যই তো ধরা পড়ল।”
শাহেদ একেবারে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “কিন্তু এদেরকে মেরে ফেললে আর থাকবে না বাবা! সারা পৃথিবীতে একটাও থাকবে না!”
শাহেদের বাবা একটু অবাক হয়ে অন্যদের দিকে তাকালেন। শংকরের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কেমন করে এসব জান?”
শংকর বলল, “মনে নাই একজন আপু আমাদেরকে এত মোটা একটা বই দিয়েছিল? ইংরেজি বই। সেখানে পড়েছি।”
“তোরা ইংরেজি বই পড়েছিস?”
“হ্যাঁ বাবা। তুমি বলেছ আমরা লেখাপড়া করে অনেক কিছু শিখব, আমরা এটা শিখেছি।”
শাহেদ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, কাকা এই পৃথিবীতে সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। করাত মাছ পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমাদের এই মাছকে বাঁচাতে হবে!”
শংকর বলল, “বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে।”
করাত মাছটা অনেকক্ষণ হুটোপুটি করে মনে হয় একটু ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। শাহেদ বলল, “দেখো বাবা—মাছটা আমাদের কথা শান্ত হয়ে শুনছে! ও বুঝতে পেরেছে আমরা তাকে বাঁচাতে চাইছি!”
শাহেদের বাবা হেসে ফেললেন। ট্রলারের সবচেয়ে বুড়ো জেলে বলল, “পোলাপান এতো করে চাইছে—ছেড়ে দাও মাছটাকে। দোয়া করবে তোমাদের।”
শাহেদ আর শংকর আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!”
শংকরের বাবা বললেন, “কিন্তু কাকু, ছাড়ব কেমন করে? এর করাতটা জালের সাথে কেমন করে আটকেছে দেখেছেন?”
শাহেদ বলল, “কাকা, এর করাতটা দিয়ে সে সব কিছু বুঝতে পারে—এইটা সাধারণ করাত না!”
শংকর মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ বাবা।”
শাহেদের বাবা বললেন, “ছাড়া তো এতো সোজা না, জালটা কেটে এটাকে ছুটাতে হবে।”
শংকরের বাবা বললেন, “দেড় দুই হাজার টাকার ধাক্কা।”
শাহেদ বলল, “আপনারা চিন্তা করবেন না কাকা। আমরা টাকাটা দিয়ে দেব।”
শংকরের বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন, “টাকাটা দিয়ে দেবে? কোথায় পাবে এতো টাকা?”
শাহেদ বলল, “আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করব, তাহলে বৃত্তি পেয়ে যাব। বৃত্তির সব টাকা দিয়ে দেব।”
শংকরও জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। সব টাকা দিয়ে দেব।”
তারা মোটেও হাসির কোনো কথা বলেনি, কিন্তু তাদের কথা শুনে ট্রলারের সব জেলেরা হো হো করে হেসে উঠল। শংকর আর শাহেদ বুঝতে পারল না কেন সবাই হেসে উঠেছে।
বুড়ো জেলে বলল, “ঠিক আছে! তোমাদের আর টাকা দিতে হবে না! আমি মালিককে বুঝিয়ে বলব! জালতো এমনিতেই মাঝে মাঝে ছিড়ে! দেখি, একটা ধার দা দেও দেখি। জালটা কেটে করাত মাছটাকে ছেড়ে দিই! বাচ্চাগুলি এতো করে চাইছে!”
আরো একজন বলল, “হ্যাঁ, কাকা ছেড়ে দাও? কী আজব, বইয়ে নাকি লেখা এই করাত মাছের কথা! আমরা মুখ্যু সুখ্যু মানুষ, বই পড়ি না! এরা তো বই পড়ে কতোকিছু জানে!”
বুড়ো জেলে খুব সাবধানে জালটা কেটে করাত মাছটাকে ছুটিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে সেটা তার লেজের ঝাপটা দিয়ে পানি ছিটিয়ে সমুদ্রে ডুবে গেল, শাহেদ আর শংকর তখন আনন্দে চিৎকার করে হাততালি দিয়ে উঠে! ওরা দুজন যখন সমুদ্রের পানির দিকে তাকিয়েছিল তখন দেখল ছাড়া পাওয়া করাত মাছটা পানির নিচ থেকে একটু ভেসে উঠে তাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে আবার পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শংকর বলল, “দেখলি? দেখলি? আমাদের থ্যাঙ্ক ইউ বলতে এসেছিল?”
শাহেদ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।” একটু থেমে বলল, “মিলিয়া আপুকে একটা চিঠি লিখতে হবে। বলতে হবে আমরা একটা করাত মাছকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। অনেক খুশি হবে মিলিয়া আপা।“

* * *

আজকে মিলিয়া হাসানের খুব আনন্দের দিন, সে তার পিএইচডি পরীক্ষা পাশ করেছে। এই মাত্র তার ডিপার্টমেন্টের স্যার আর ম্যাডামেরা এসে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে গেছেন। এখন থেকে সে শুধু মিলিয়া হাসান নয়, সে হচ্ছে ডক্টর মিলিয়া হাসান। নামের আগে এই ডক্টর শব্দটা লাগানোর জন্য সে ছয় বছর গবেষণা করেছে, কতো সময় ল্যাবরেটরিতে বসে থেকেছে, কত দেশের সমুদ্র ঘুরে বেড়িয়েছে।
সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যেতে যেতে মিলিয়া তার মেল বক্সে উঁকি দিল। সেখানে একটা হলুদ খাম পড়ে রয়েছে। খামের উপর অনেকগুলো ডাকটিকেট, খামের উপরে কাঁচা হাতে ঠিকানা লেখা। দেশ থেকে কেউ একজন তাকে চিঠি পাঠিয়েছে। হাতে লেখা চিঠি, কী আশ্চর্য!
মিলিয়া খামটা খুলল, ভেতরে কাঁচা হাতে লেখা—

মিলিয়া আপু,
আমরা শাহেদ আর শংকর, আমাদের কথা আপনার মনে আছে? আপনি আমাদের দুইজনকে করাত মাছের উপর একটা বই দিয়েছিলেন? ইংরেজি বই?
আপনি শুনে খুশি হবেন কয়েকদিন আগে সমুদ্রে মাছ ধরার সময় জালে একটা করাত মাছ আটকা পড়েছিল। আমরা দুইজন আমাদের বাবা কাকাদের মাছটাকে ছেড়ে দিতে বলেছিলাম তারা আমাদের কথা শুনে মাছটাকে ছেড়ে দিয়েছিল।
করাত মাছটা ছাড়া পেয়ে নিশ্চয়ই আমাদের জন্য দোয়া করেছে। আপনার জন্যও দোয়া করেছে, সেই জন্য আপনাকে লিখে জানালাম। . . .

মিলিয়ার চোখটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে উঠে। সারা পৃথিবী ছোটাছুটি করে সে যেটা করতে পারেনি এই ছোট বাচ্চা দুটো তার জন্য সেটা করে ফেলেছে!

এরকম বাচ্চা যদি পৃথিবীতে থাকে তাহলে সেই পৃথিবী নিয়ে আর দুর্ভাবনার কী আছে?

২৫ এপ্রিল ২০২১

ছোট্ট একটা নেংটি ইদুঁর


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বনের ধারে একটা মাদার গাছের নিচে একটা গর্তে থাকতো ছোট্ট একটা নেংটি ইদুঁর তার মা বাবা আর ভাই বোনদের নিয়ে। সে ছিলো ছোট্ট, একটুখানি, তার কান দুটো ছিল বড় আর লেজটা ছিল লম্বা, গোলাপী রংয়ের।
ছোট্ট নেংটি ইদুঁরের ভাই বোনেরা সবসময় তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতো। তারা বলতো:

ছোট্ট নেংটির মস্ত বড় লেজ
দেখি দেখি তার কত্তোখানি তেজ

তারপর তারা তার লেজ ধরে দিতো হ্যাচকা টান। ছোট্ট সেই নেংটি ইদুঁর তখন রেগে মেগে বলতো, “ভালো হবে না কিন্তু। আমাকে রাগিয়ে দিও না—তাহলে দেখো আমি কি করি।”
“তুমি তাহলে কী করবে ছোট্ট নেংটি?”
“আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।”
তার ভাই বোনেরা তখন বলতো, “সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।”
“তাহলে তুমি একটা হাতিকে ধরে আনো দেখি।”
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর কখনো হাতি দেখেনি, তাই সে ভাবল, এটা আর এমন কী কঠিন? তাই সে বলল, “ধরে তো আনতেই পারি! তোমরা ভেবেছ কী, পারব না?”
ছোট্ট নেংটি ইদুঁরের কথা শুনে তার ভাই বোনেরা পেটে হাত দিয়ে হাসিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু করতো। এরপর থেকে তারা ছোট্ট নেংটি ইদুঁরকে দেখলেই বলতো:

ছোট্ট নেংটির বিশাল বুকের ছাতি
একদিন সে ধরে আনবে মস্ত বড় হাতি।

ভাই বোনদের ঠাট্টা শুনতে শুনতে ছোট্ট নেংটি ইদুঁর একেবারে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেল। তাই সে একদিন চিকন একটা দড়ি নিয়ে বের হলো হাতি ধরে আনার জন্য।
প্রথমেই দেখা হলো তার একটা ব্যঙের সাথে। ব্যঙকে ছোট্ট নেংটি ইদুঁর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী হাতি?”
ব্যঙ বলল, “না, না, আমি হাতি না! আমি ব্যঙ।”
ছোট্ট নেংটি বলল, “আমি যাচ্ছি একটা হাতি ধরে আনার জন্য।”
ব্যঙ তখন পেটে হাত দিয়ে খিক খিক করে হাসতে হাসতে সবাইকে ডেকে বলল, “দেখো তোমরা সবাই এসে দেখো! আমাদের ছোট্ট নেংটি ইদুঁর একটা হাতি ধরে আনতে যাচ্ছে!”
সবাই তখন হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর কারো কথা না শুনে হন হন করে হেঁটে যেতে লাগল। পথে তার খরগোসের সাথে দেখা হলো, কাঠবিড়ালীর সাথে দেখা হলো, বেজীর সাথে দেখা হলো, বানরের সাথে দেখা হলো—সবাইকে সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী হাতি?”
সবাই বলল, যে তারা হাতি না। হাতি হবে অনেক বড়, তার কান হবে কুলার মত, পা হবে থাম্বার মত আর শুঁড় হবে অনেক লম্বা।
খুঁজতে খুঁজতে ছোট নেংটি ইদুঁর শেষ পর্যন্ত হাতিকে পেয়ে গেল। সে তখন তার চিকন গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিশ্চয়ই হাতি। তাই না?”
হাতি বিশাল একটা কলাগাছ খেতে খেতে বলল, “হ্যাঁ, আমি হাতি।”
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর বলল, “আমি তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।”
হাতি বলল, “তাই নাকি?”
নেংটি ইদুঁর বলল, “হ্যাঁ। এই দেখো আমি দড়ি নিয়ে এসেছি।”
“দড়ি দিয়ে তুমি কী করবে?”
“তোমাকে বেঁধে ফেলব। তারপর টেনে টেনে নিয়ে যাব।”
হাতি নেংটি ইদুঁরের কথা শুনে দুলে দুলে হাসতে লাগলো। তারপর শুঁড় দিয়ে খপ করে একটা ফড়িং ধরে ছোট্ট নেংটি ইদুঁরকে দিয়ে বলল, “তার চাইতে তুমি এই ফড়িংটা ধরে নিয়ে যাও।”
নেংটি ইদুঁর তখন ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। হাতি জিজ্ঞেস করল, “কী হল? তুমি কাঁদছ কেন?”
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর বলল, “আমি ছোট্ট সেই জন্যে সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। আমি যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে না পারি তাহলে সবাই আমাকে নিয়ে আরো বেশী ঠাট্টা করবে।”
হাতির তখন ছোট্ট নেংটি ইদুঁরের জন্য মায়া হলো। তখন সে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে তুমি আমাকে ধরে নিয়ে যাও।”
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর তখন তার দড়ি দিয়ে হাতির শুঁড়টা বেধে ফেলার চেষ্টা করল। কেমন করে গিট দিতে হয় সে জানত নাই। তাই হাতি তাকে সাহায্য করল। তারপর সে হাতিকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। ছোট্ট নেংটি ইদুঁরের পিছু পিছু বিশাল হাতি থপ থপ করে হেঁটে যেতে থাকল।
বনের সব পশু সেটা দেখে অবাক হয়ে গেল। সবাই হাতিকে জিজ্ঞেস করল, “হাতি, কি হয়েছে?”
হাতি মুচকি হেসে বলল, “দেখছ না, ছোট্ট নেংটি ইদুঁর আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”
সবাই তখন হা করে তাকিয়ে রইল।

ছোট্ট নেংটি ইদুঁর হাতিকে নিয়ে বনের ধারে মাদার গাছের নিচে তার গর্তের কাছে এসে তার ভাই বোনদের ডেকে বলল, “আমি বলেছিলাম না হাতিকে ধরে আনব? এই দেখো, আমি হাতিকে ধরে এনেছি।”
তার ভাই বোনেরা গর্ত থেকে বের হয়ে এই বিশাল হাতিকে দেখে একেবারে ভিমরি খেয়ে গেল। ভয়ে তাদের হাত পা কাঁপতে লাগল, মাথা ঘুরতে থাকল, শরীর ঘামতে লাগল। তারা কী বলবে বুঝতে পারল না।
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর বলল, “এখন তোমাদের বিশ্বাস হয়েছে যে আমার যেটা ইচ্ছা হয় আমি সেটাই করতে পারি?”
তার ভাই বোনেরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “হ্যা, বিশ্বাস হয়েছে।”
“তাহলে কী আমি এখন হাতিকে ছেড়ে দিব? নাকি মাদার গাছের সাথে বেঁধে রাখব?”
তার ভাই বোনেরা তাড়াতাড়ি বলল, “ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। এক্ষুনি ছেড়ে দাও।”
ছোট্ট নেংটি ইদুঁর তখন হাতির শুঁড়ের বাঁধনটা খুলে হাতিকে বলল, “ঠিক আছে হাতি তোমাকে ছেড়ে দিলাম। তুমি যাও।”
হাতি তার শুঁড় তুলে নেংটি ইদুঁরকে সেল্যুট দিয়ে বলল, “অনেক অনেক থ্যাংকু তোমাকে।”
তারপর সে থপ থপ করে হেঁটে চলে গেল।

ছোট্ট নেংটি ইদুঁরের ভাই বোনেরা তারপর আর কোনোদিন তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতো না। এখন তারা তাকে দেখলে বলে:
আমাদের এই ছোট্ট নেংটি ইদুঁর ভাই
পারে না এমন কাজ পৃথিবীতে নাই!

আগস্ট ২০১৯

এক সেট গয়না

 


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

দরজায় টুংটাং শব্দ শুনে টুনি দরজা খুলে দেখে দরজার সামনে ফারিহা দাড়িয়ে আছে। ফারিহা তার মাথার চুল ছোট করে কেটে ফেলেছে, সেজন্যে আজকে তাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। টুনি খুশী খুশী মুখে বলল, “ফারিহাপু, তোমাকে দেখতে আজকে কী সুইট লাগছে!”
ফারিহা তার ছোট ছোট চুলের ভেতর আংগুল ঢুকিয়ে হাসি মুখে বলল, “ভেবেছিলাম ন্যাড়া করে ফেলব। শেষ পর্যন্ত আর করলাম না।”
টুনি বলল, “কেন করলে না ফারিহাপু?”
“মনে হল আমার মাথার চাঁদিটা ঢেউ ঢেউ। দেখতে কেমন লাগবে সেটা ভেবে আর ন্যাড়া করলাম না।”
টুনি হি হি করে হেসে বলল, “মাথার চাঁদি কখনো ঢেউ ঢেউ হয় না ফারিহাপু।”
“হয়, হয়!” বলে ফারিহা ভেতরে ঢুকে একটা সোফায় বসে বলল, “শাহরিয়ার আছে?’
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আছে। তুমি বস ফারিহাপু আমি ডেকে দিই।”
ফারিহা আবার তার চুলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বলল, “আমার চুল দেখে শাহরিয়ার কী বলবে মনে হয়?”
টুনি মুখ টিপে হাসল, বলল, “ছোটাচ্চু ভাণ করবে যে সে লক্ষই করেনি!”
ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “আমারও তাই মনে হয়। দেখি, ডেকে আনো দেখি।”
ছোটাচ্চু এসে ফারিহাকে দেখে একটুখানি চমকে উঠল কিন্তু সত্যি সত্যি ভাণ করল যে সে ফারিহার ছেলেদের মত করে কাটা চুলটা আলাদা করে লক্ষ করেনি। খানিকটা উদাস মুখ করে বসে রইল। তখন ফারিহা নিজেই জিজ্ঞেস করল, “আমার এই চুলের স্টাইলটা তোমার কেমন লাগছে শাহরিয়ার?”
ছোটাচ্চু বলল, “সত্যি করে বলব?”
“সত্যি করেই তো বলবে।”
“তোমাকে দেখতে একটা ছেলের মতো লাগছে। শুধু ছেলে না, কেমন যেন গুণ্ডা গুণ্ডা টাইপ।”
ফারিহা হি হি করে হেসে নিজের হাতে নিজে কিল দিয়ে বলল, “তুমি ঠিক বলেছ। শুধু যে দেখতে গুণ্ডা গুণ্ডা লাগছে তা না। নিজেকে কেমন জানি মনেও হচ্ছে গুণ্ডা গুন্ডা।”
ছোটাচ্চু একটু ভয়ে ভয়ে ফারিহার দিকে তাকালো, বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। সত্যি। মনে হচ্ছে কারো সার্টের কলার ধরে একটা ঝাকুনী দেই। কাউকে ঘুষি মারি। কাউকে গালাগাল করি।”
ছোটাচ্চু আরো ভয়ে ভয়ে বলল, “গালাগাল? ঘুষি?”
“হ্যাঁ। বলে ফারিহাপু ছোটাচ্চুর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, “চল।”
“কোথায়?”
“দেখি, মারামারি করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় নাকী।”
ফারিহাপু সত্যি সত্যি মুখটা কেমন জানি ভয়ংকর করে এক হাত দিয়ে অন্য হাতে আস্তে আস্তে ঘুষি মারতে লাগল।
ছোটাচ্চু উঠে দাড়িয়ে বলল, “দাঁড়াও সার্টটা একটু বদলে আসি।”
ফারিহা বলল, “ঠিক আছে, যাও।”
ছোটাচ্চু ঘর থেকে বের হতেই ফারিহাপু খিল খিল করে হাসতে লাগলো। টুনির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল, “দেখেছ? দেখেছ? তোমার ছোটাচ্চু সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছে।”
টুনিও হাসল, বলল, “হ্যাঁ। আর তুমি বলেছ খুব জোর দিয়ে। ছোটাচ্চুকে যে যেটাই বলে সেটাই বিশ্বাস করে।”
ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “সেইটা ঠিক।”
টুনি এবারে একটু ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু তুমি কী সত্যি সত্যি এখন কারো সাথে মারামারি করতে যাবে?”
ফারিহা মাথা চুলকে বলল, “বলে যখন ফেলেছি, তখন তো করতেই হবে। মারামারি না হোক একটু ঝগড়াঝাটি তো করা দরকার। কার সাথে করা যায়?”
টুনি বেশ খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে ফারিহার দিকে তাকিয়ে রইল। ফারিহাপু পারে না সেরকম কাজ নেই।

গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ এক সময় ফারিহা বলল, “ঢিশ ঢিশ ঢিশুম।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে বলল, “ঢিশ ঢিশ ঢিশুম মানে কী?”
“কোনো মানে নাই।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে এটা বলছ কেন?”
ফারিহা বলল, “কী আশ্চর্য, যে কথাটার মানে নাই সেই কথা বলা যাবে না?”
“আগে তো বলতে না। সেই জন্যে বলছি।”
ফারিহাপু তখন হঠাৎ করে ব্রেক করে তার গাড়ী থামালো। ফারিহাপুর গাড়ীতে উঠলে সবাইকে সিট বেল্ট লাগাতে হয়, তা না হলে নির্ঘাত ছোটাচ্চু সামনের ড্যাশ বোর্ডে একটা ধাক্কা খেতো। ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হল?”
“চল।”
“চল? কোথায়?”
“চিনতে পারছ না কোথায়?”
জায়গাটা তখন ছোটাচ্চু চিনতে পারল। এই খানে তার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস ছিল। ছোটাচ্চু মাথা বের করে তাকিয়ে দেখল, এখনো অফিসের সাইনবোর্ডটা আছে, তার মানে তার ডিটেকটিভ এজেন্সীটা উঠে যায় নাই। সরফরাজ কাফী তার অফিসটা দখল করে তাকে বের করে দিয়েছে কথাটা চিন্তা করলে আগে ছোটাচ্চুর রাগের মাথা গরম হয়ে যেতো। আজকাল আর হয় না। ব্যাপারটা চিন্তা করলে তার কাছে এখন পুরো ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর মনে হয়।
ছোটাচ্চু ভুরু কুচঁকে বলল, “এখানে থেমেছ কেন?”
“তোমার সরফরাজ কাফীকে একটু কচলে আসি।”
“কচলে আসবে? কচলে আসা আবার কী রকম কথা?” ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে ফারিহার দিকে তাকালো। ফারিহা হঠাৎ করে এরকম অদ্ভূত ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে।
ফারিহাপু এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি দিতে দিতে বলল, “সরফরাজ কাফী মানুষটা এতো বড় একটা দুই নম্বরী কাজ করেছে তারপরেও তার সাথে একবারও কেউ কোনো কথা বলল না, একটু ডলে দিল না, এটা তো হতে পারে না।”
ছোটাচ্চু বলল, “তুমি কী এখন তার সাথে ঝগড়া করতে যাচ্ছ?”
ফারিহাপু ফোঁস করে বলল, “আগে যাই। দেখি, ঝগড়া না মারামারি কী করা যায়।”
ছোটাচ্চু গম্ভীর হয়ে বলল, “দেখো ফারিহা—”
ফারিহা হাত নেড়ে ছোটাচ্চুর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “তুমি আস আমার সাথে। আমার উপর বিশ্বাস রাখো।” কথা শেষ করে ফারিহা ছোটাচ্চুর হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।
আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির দরজা খুলে অনেক দিন পর ছোটাচ্চু ফারিহাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। আগে যেখানে রঞ্জনা বসতো এখন সেখানে আরেকজন মেয়ে বসে আছে। মাথার চুলগুলো উঁচু করে বাধা, মুখে কড়া মেকআপ, ঠোটে কটকটে লাল রং। রঞ্জনা সবসময় শাড়ী পরে থাকতো এই মেয়েটা বিদঘুটে রংয়ের একটা সালোয়ার কামিজ পরে আছে। মেয়েটির সামনে বসে একজন বয়স্কা মহিলা তার কথা বলছেন, ছোটাচ্চু এবং ফারিহাকে ঢুকতে দেখে দুজনেই তাদের দিকে ঘুরে তাকালো। মেকআপ করা মেয়েটি দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গী করে বলল, “ওয়েলকাম টু দা আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
ফারিহা বলল, “আমরা সরফরাজ কাফীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
মেয়েটি বলল, “কাফী স্যার তো নেই। উনি সবসময় এখানে আসেন না। আপনারা কী এপয়ন্টমেন্ট করে এসেছেন?”
ফারিহা মাথা নাড়ল, “না, এপয়ন্টমেন্ট করে আসি নাই।”
“আপনাদের কেসটা আমাকে বলতে পারেন, আমি দেখি কী করতে পারি।”
সামনে বসে থাকা মহিলাটা একটু অধৈর্য্য হয়ে বললেন, “আমার কেসটা আগে শেষ করে দেন।”
মেকআপ করা মেয়েটা মহিলাটার দিকে তাকিয়ে আবার দাঁত বের করে হাসার মত একটা ভয়ংকর ভঙ্গী করে বলল, “ম্যাডাম, সব কাস্টমার আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবাইকে আমাদের সমানভাবে দেখতে হবে।”
মহিলা বিরক্ত হয়ে বললেন, “সেটা দেখতে চান দেখেন, কিন্তু আমার কাজটা করে দিতে পারবেন কী না বলেন।”
“অবশ্যই পারব। দা আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী পারে না এমন কোনো কাজ নেই। ঐ যে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, আমাদের বড় বড় কেসগুলোর কথা আমরা বোর্ডে টানিয়ে রেখেছি। কিন্তু একশান প্ল্যানটা কী হবে সেটা ঠিক করতে হবে। এডভান্স পেমেন্টের একটা ব্যাপার আছে—”
সামনে বসে থাকা মহিলা এবারে আরেকটু বিরক্ত হলেন। বললেন, “কী মুশকিল! ঘুরে ফিরে আপনাদের শুধু একটা কথা! পেমেন্ট! পেমেন্ট! আরে বাবা, আমি কী না করেছি যে পেমেন্ট করব না?”
ছোটাচ্চুর লজ্জা পাবার কিছু নেই, এটি এখন আর তার ডিটেকটিভ এজেন্সী নয়, কিন্তু তবু সে কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। হেঁটে হেঁটে তখন ঘরের অন্য মাথার বোর্ডে ঝোলানো আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর বড় বড় কেসগুলো দেখতে গেল। তাকে বের করে দেবার পর সরফরাজ কাফী কী কী কেস করেছে দেখার জন্য তার বেশ কৌতুহল হলো। তবে বোর্ডে ঝোলানো কেসগুলো দেখে ছোটাচ্চু বেশ অবাক হলো, এখানে নতুন একটি কেসও নেই। ছোটাচ্চু এখানে থাকার সময় যে কেসগুলো করেছে সেগুলোর কথাই লেখা। কী আশ্চর্য! সরফরাজ কাফী এতদিন তাহলে করছে কী?
পাশে একটা শেলফ, সেখানে অনেকগুলো মগ, টি-শার্ট এবং চাবির রিং। সেগুলোর উপরে বড় বড় করে লেখা দি আলটিমেট ডিকেটটিভ এজেন্সী। তার এক সময়কার ডিটেকটিভ এজেন্সী কী এখন মগ আর টি-শার্ট বিক্রি করে চলছে? কী আজব!
ঠিক তখন তখন ফারিহার গলা শুনে ছোটাচ্চু ঘুরে তাকালো। ফারিহা মেকআপ করা মেয়েটার সাথে কথা বলছে। সরফরাজ কাফী যেহেতু নেই সে তার রাগ ঝাড়ার কোনো মানুষ পাচ্ছে না তাই এখন সে কী করবে বুঝতে পারছে না। ফারিহা কী বলছে শোনার জন্য ছোটাচ্চু কান খাড়া করল। শুনল ফারিহা জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কী সব ধরনের কেস নেন?”
মেক আপ করা মেয়েটা বলল, “অবশ্যই! অবশ্যই নেই।”
“একজন মানুষ যদি আরেকজনের কোম্পানী দখল করে নেয় সেটার তদন্ত করতে পারবেন?”
এই মেয়েটি নিশ্চয়ই নতুন। সরফরাজ কাফী যে ছোটাচ্চুর দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী দখল করে নিয়েছে সেটা নিশ্চয়ই জানে না। তাই খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, “অবশ্যই তদন্ত করতে পারব। কোম্পানী দখল করে নেয়া তো ছেলে খেলা নয়। ঘাঘু ক্রিমিনালরা ছাড়া এটা পারে না। আপনি শুধু বলেন, আমরা আমাদের এজেন্টদের লাগিয়ে দেব, দুই সপ্তাহে তদন্ত করে সব বের করে আনবে। ক্রিমিনালদের সোসাইটিতে ঘুরে বেড়ানোর কথা নয়। ক্রিমিনালরা থাকবে জেলখানার ভিতরে—”
“গুড!” ফারিহা এবারে খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, “একটা কাগজে লিখেন। কোম্পানীটার নাম হচ্ছে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী।”
ছোটাচ্চু দূর থেকে দেখলো মেকআপ করা মেয়েটার চোয়াল কটাস করে ঝুলে পড়েছে। ফারিহা সেটা খেয়াল করল না, টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “কোম্পানীটার মালিক ছিল শাহরিয়ার হাসান। ঐ যে দাড়িয়ে আছে।”
মেকআপ করা মেয়ে এবং সামনে বসে থাকা মহিলা দুই জনেই মাথা ঘুরিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো। ছোটাচ্চু আর কী করবে? দূর থেকে মুখটা একটু হাসি হাসি করে হাত নেড়ে দিল।
ফারিহা বলল, “আর যে ক্রিমিনালটা শাহরিয়ার হাসানের কোম্পানীটা দখল করেছে তার নাম হচ্ছে সরফরাজ কাফী।
মেক আপ করা মেয়েটার ঝুলে থাকা চোয়াল কটাস করে একবার বন্ধ হয়ে আবার খুলে গেল। তারপর খুলতে লাগল এবং বন্ধ হতে লাগলো। ফারিহা সেটা খেয়াল করল বলে মনে হল না। এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি দিতে দিতে বলল, “ধরা যাবে তো সরফরাজ কাফীকে? জেলখানার ভাত খাওয়ানো যাবে তো? কমপক্ষে এক বেলা? কিছু এডভান্স কী করে যাব?”
মেক আপ করা মেয়েটি কী বলতো কে জানে, কিন্তু ঘটনাটা আরো জমজমাট করার জন্য ঠিক তখন বাইরের দরজা খুলে গেলো এবং সরফরাজ কাফী এসে ঢুকল। ছোটাচ্চু দেখলো সরফরাজ কাফী ঠিক আগের মতই আছে। আগের মতই পরনে স্যুট এবং টাই। মাথার চুল মনে হয় আরো একটু পাতলা হয়েছে, আগের মতই মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুল দুইভাগে ভাগ করে চাঁদীটা ঢেকে রেখেছে। তার মুখে আগের মতই একটা তেলতেলে ভাব।
সরফরাজ কাফীকে দেখে মেক আপ করা মেয়েটি প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাড়ালো। সরফরাজ কাফী ছোটাচ্চুকে তখনো দেখেনি, তার মুখের তেলতেলে হাসিটাকে পিছলে একটা হাসি বানিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গুড মর্নিং লিন্ডা। আমদের কী নূতন কোনো কেস এসেছে?”
মেক আপ করা মেয়েটা বলল, “না স্যার—মানে স্যার, ইয়ে বলছিলাম কী, মনে হয় একটা গোলমাল—মানে স্যার ইয়ে—যেটা বলছিলাম কিন্তু মানে ইয়ে—” কথাটার কোনো মাথা মুন্ডু নেই এবং কথাটা শেষও করতে পারল না, মাঝখানে থেমে গিয়ে লিন্ডা নামের মেক আপ করা মেয়েটা মাছের মত খাবি খেতে লাগল। সরফরাজ কাফীর কিছু একটা সন্দেহ হল তখন মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে ছোটাচ্চুকে প্রথমবার দেখতে পেলো এবং সাথে সাথে তার মুখটা কেমন জানি শক্ত হয়ে গেল। তার চোখে প্রথমে বিস্ময় তারপরে সন্দেহ এবং সবশেষে ভয় এসে ভর করল।
ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “অনেকদিন আপনার সাথে যোগাযোগ নেই। কেমন আছেন সরফরাজ সাহেব? আপনার কফি মগ, টি-শার্ট আর কী-রিং কেমন বিক্রি হচ্ছে?”
সরফরাজ কাফী কোনো উত্তর দিল না, চোখ বড় বড় করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। ফারিহা আগে কখনো সরফরাজ কাফীকে দেখেনি তাই প্রথমে চিনতে পারেনি। ছোটাচ্চুর কথা শুনে সে বুঝতে পারল এই সেই দুই নম্বুরী সরফরাজ কাফী। সে তড়াক করে লাফ দিয়ে বলল, “ও! আপনিই সেই মানুষ! অনেকদিন থেকে আমি আপনাকে খুজঁছি।”
ফারিহা এক হাতের তালুতে অন্য হাত দিয়ে ঘুষি দিতে দিতে সরফরাজ কাফীর দিকে এগিয়ে যায় আর সরফরাজ কাফী প্রায় লাফিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। আরেকটু হলে একটা চেয়ারের সাথে পা বেঁধে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। ফারিহা একেবারে বিপজ্জনকভাবে খুব কাছাকাছি গিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি শাহরিয়ারের কাছে আপনার দুই নম্বুরী কাজ কর্মের কথা শুনেছি কিন্তু আপনাকে কখনো দেখি নাই। আপনি দেখতে কেমন হতে পারেন, সেইটা নিয়ে আমার মনের মাঝে একটা কল্পনা ছিল। আপনি জানেন, আপনার চেহারা আমার কল্পনার সাথে হুবহু মিলে গেছে! একেবারে হুবহু!”
সরফরাজ কাফী কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল কিন্তু পরিস্কারভাবে বলতে পারল না। গলা দিয়ে শুধু বিদঘুটে একটা আওয়াজ বের হলো। ফারিহা আরেকটু এগিয়ে যায়, সরফরাজ কাফী আরো অনেকটুকু পিছিয়ে যায়। ফারিহা হঠাৎ মুখটা কঠিন করে কেমন যেন হিস হিস শব্দ করে বলল, “অনেকদিন থেকে ভাবছি ব্যাপারটা আপনার সাথে হেস্ত নেস্ত করতে আসব। শাহরিয়ারকে সোজা মানুষ পেয়ে তার কোম্পানী দখল করে নিয়েছেন, সে ভালোমানুষ, কিছু বলে নাই। আমি ভালো মানুষ না—আমি—”
ফারিহা কী ধরনের মানুষ বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই ছোটাচ্চু প্রায় লাফ দিয়ে এসে ফারিহার হাত ধরে টাকে টেনে সরিয়ে নেয়। রীতিমত ধাক্কা দিয়ে তাকে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর অফিস থেকে বের করে নিতে নিতে বলল, “কী শুরু করেছ ফারিহা। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? চল, চল বের হও এখান থেকে।”
ফারিহা হুংকার দিয়ে বলল, “ভালো হবে না শাহরিয়ার। আমাকে ছেড়ে দাও, কোন মানুষকে কীভাবে সাইজ করতে হয় তুমি জান না—”
“আমার জানতে হবে না। চল। চল। বের হও।” বলে ছোটাচ্চু ফারিহাকে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর অফিস থেকে রীতিমত টেনে বের করে নিয়ে এলো।

গাড়ীতে উঠে ফারিহা স্টিয়ারিং হুইলে দুই হাত রেখে ফোঁস ফোঁস শব্দ করতে লাগল। ছোটাচ্চু বলল, “তোমর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এই ভাবে কেউ কথা বলে?”
“আমি বলি।”
“বলা ঠিক না। ঝগড়াঝাঁটি চেচামেচি করে দুনিয়ার কোনো কাজ হয় না।”
“হয়।”
“কী হয়?”
“এক ধরনের আরাম হয়।”
“চুলকানি হলে সেটা খামচালেও আরাম হয়। তার মানে এই না যে আমি শরীরে চুলকানি বানাব খামচানোর জন্য—”
ফারিহা বলল, “ইশ! তুমি যে কী বাজে কথা বলতে পার।” তারপর গাড়ী স্টার্ট করে যেই রওনা দেবে ঠিক তখন দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী থেকে বয়স্কা মহিলাটি বের হয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে চিৎকার করতে লাগলেন “দাড়ান। দাড়ান। যাবেন না। যাবেন না। আগেই যাবেন না।”
ফারিহা তার গাড়ী থামালো। মহিলাটি সিড়ি দিয়ে নেমে এসে ফারিহার জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি সেই বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ার সাহেব? এই ডিটেকটিভ এজেন্সীর আসল মালিক?”
ছোটাচ্চু একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “বিখ্যাত ডিটেকটিভ কিনা জানি না। তবে হ্যাঁ এই এজেন্সীটা আমি তৈরি করেছিলাম।”
“আমি আসলে আপনার কাছেই এসেছিলাম। এসে শুনি আপনি আর এখানে কাজ করেন না।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, কিছু বলল না। মহিলা বললেন, “আমার নাম রওশন আরা। আমার একটা কেস ছিল, খুবই সেনসিটিভ। যদি একটু দেখতেন।”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “আমি আসলে ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দিয়েছি।”
“সেকী। আপনার মত এতো বড় ডিটেকটিভ যদি কাজ ছেড়ে দেন তাহলে কেমন করে হবে?”
“আমি মোটেও বড় ডিটেকটিভ না। কিন্তু সেটা বড় কথা না ডিটেকটিভ এজেন্সীর কাজ আর ভালো লাগে না।”
মহিলা অনুনয় করে বলল, “আমার কেসটা একটু করে দেন প্লিজ। আপনার জন্য খুবই সহজ হবে কাজটা। একেবারে পানি ভাত।”
ছোটাচ্চু একটু হেসে ফেলল। বলল, “কী রকম কেস?”
“আমার আলমারী থেকে আমার একটা গয়নার সেট চুরি গেছে। চাবি থাকে আমার কাছে, সেটা কেউ নিয়ে চুরি করেছে। বাসার কেউ নিশ্চয়ই নিয়েছে কিন্তু কাকে সন্দেহ করব?”
“বাসায় কারা থাকে?”
“অনেকে থাকে। ফেমিলি মেম্বাররা আছে, কাজের মানুষজন আছে। কিছু আত্মীয় স্বজনও আছে।”
“কাউকে সন্দেহ করেন?”
“না। কাকে সন্দেহ করব? সবাই নিজের মানুষ। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে তাদের ভেতর থেকেই কেউ নিশ্চয়ই চুরি করেছে। খুবই দুঃখের ব্যাপার।”
ছোটাচ্চু মুখ সূচালো করে বললেন, “আপনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর যে আপনার বাসায় যারা আছে তাদের ভেতর থেকেই একজন চুরি করেছে?”
“জী। হান্ড্রেড এন্ড টেন পার্সেন্ট শিওর।”
“সবাইকে এক সাথে পাওয়া যাবে?”
রওশান নামে মহিলা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “জী পাওয়া যাবে।”
ছোটাচ্চু হঠাৎ হেসে ফেলল। মিসেস রওশান অবাক হয়ে বললেন, “হাসছেন কেন?”
“একটা খুবই সোজা উপায় আছে। নাসিরুদ্দিন হোজ্বার একটা গল্পে এটা আছে। আপনি করবেন কী—”
ফারিহা বলল, “দাড়াও শাহরিয়ার। মিসেস রওশান জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে কথা বলছেন, তুমি গাড়ীর সিটে বসে কথা বলছ। এভাবে হয় না। কোথাও বসে কথা বল।”
ছোটাচ্চু বলল, “কোন দরকার নেই। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার টেকনিকটা খুবই সোজা টেকনিক। আমি এক মিনিটে বলে দিতে পারব। আপনি প্রথমে একটা—”
মিসেস রওশান জোরে জোরে মাথা নাড়ালেন। বললেন, “না না না। আমি নিজে কিছুই করব না। আপনাকে কষ্ট করে আমার বাসায় একটু আসতে হবে। প্লিজ, আসতেই হবে। আসতেই হবে। আপনার টেলিফোন নম্বরটা আমাকে দেন। আমি বাসায় গিয়ে সবাইকে একত্র করে আপনাকে ফোন করব। ঘণ্টখানেক সময় দেন।”
কাজেই ছোটাচ্চুকে তার ফোন নম্বর দিতে হলো। মিসেস রওশান ছোটাচ্চুর নম্বরটা নেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত গাড়ীর জানালা থেকে তার মাথা বের করলেন। ফারিয়াও শেষ পর্যন্ত তার গাড়ী স্টার্ট করতে পারল।

ঘণ্টাখানেকের আগেই মিসেস রওশানের ফোন চলে এলো। ফোনে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন। ফারিহার আপাতত কোনো কাজ নেই তাই সে ছোটাচ্চুকে সেই বাসায় নিয়ে গেল।
মিসেস রওশনের বাসাটা অনেক সুন্দর। বাসার দারোয়ান গেট খুলে মাথা ঝুকিয়ে তাদের দুজনকে লম্বা করে সালাম দিল, মিসেস রওশান নিশ্চয়ই গেটে আগে থেকে বলে রেখেছেন। ফারিহা গাড়ী ভেতরে ঢুকিয়ে বারান্দার সামনে থামাল। দুইজন গাড়ী থেকে নামতেই দেখল বারান্দায় মিসেস রওশান বারান্দায় দাড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “আসেন, আসেন। বাড়ী খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না। অসুবিধা হয় নাই।”
“ভেতরে আসেন। ডাইনিং হলে সবাই অপেক্ষা করছে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল “কতোজন?”
“আমাকে নিয়ে সতেরোজন।”
“বেশ বড় ফেমিলি।”
“হ্যাঁ। বাচ্চা কাচ্চাও আছে কয়েকজন ওদেরকে আর রাখিনি।”
“যারা সন্দেহের বাইরে তাদের রাখার দরকার নাই।”
“তবে মজা দেখার জন্য তারাও আছে।”
ছোটাচ্চু হাসল, বলল, “থাকার কথা।”
“আপনি কী কাজ শুরু করে দেবেন, নাকী আগে একটু চা নাস্তা খেয়ে নেবেন?”
“কাজ শুরু করে দিই। আমার কয়েকটি জিনিস লাগবে।”
“কী লাগবে?”
“একটা ব্যাগ আর একটা বড় তোয়ালে—”
“আর কিছু?”
“আপনার চাবির গোছাটা। আর একটা টিস্যুর বাক্স।”
“ঠিক আছে, আমি নিয়ে আসি।”
“আমি সবার সাথে আগে একটু কথা বলব। তারপর আমি বসার ঘরে বসব। ডাইনিং রুম থেকে একজন একজন করে এখানে আসবে। আমি তাদেরকে কিছু একটা করতে বলব। তারা সেটা করে চলে যাবে। যখন সবাই শেষ হবে তখন আমি মনে হয় বলে দিতে পারব কে আপনার স্টিলের আলমারী খুলেছে।”
মিসেস রওশান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার এখন একটু একটু ভয় লাগছে।”
ফারিহা জিজ্ঞেস করল, “কেন? ভয় কেন লাগছে?”
“এখানে সবাই বাসার মানুষ, নিজেদের মানুষ, আপন মানুষ। এখন যদি দেখি এদের ভিতরে একজন আমার গয়নার সেটটা চুরি করেছে তাহলে আমার কেমন লাগবে?”
ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।”
ছোটাচ্চু বলল, “এখনও চিন্তা করে দেখেন, আপনি কী সত্যিই জানতে চান?”
মিসেস রওশান মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। আমি জানতে চাই।”
“ঠিক আছে তাহলে শুরু করি।”
“চলেন।” মিসেস রওশান হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ডাইনিং রুমে সবাই অপেক্ষা করছে।”
ডাইনিং রুমে সবাই নিজেদের মাঝে কথা বলেছিল। এক সেট গয়না চুরির আসামীকে ধরার জন্য সবাইকে একত্র করা হয়েছে সেটা নিয়ে কারো মাঝে কোনো দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হলো না। দেখে মনে হলো সবাই কোনো একটা ম্যাজিক শো দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। ছোটাচ্চু আর ফারিহা ঘরের মাঝে ঢোকার সাথে সাথে সবাই আনন্দে হাততালি দিতে লাগলো।
মিসেস রওশান যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। বললেন, “কী হলো? একটা চোর ধরার জন্য সবাইকে একত্র করেছি আর সবাই আনন্দে হাত তালি দিচ্ছে? ব্যাপারটা কী?”
মাথায় টাক এবং মোটাসোটা একজন ভদ্রলোক বললেন, “ব্যাপারটা কি বুঝতে পারছ না? ব্যাপারটা হচ্ছে এই খানে তোমার চোর নাই।”
মিসেস রওশান হুংকার দিলেন, “আছে শওকত। তা না হলে আমার গয়নার সেট গেল কই?”
শওকত নামের মোটাসোটা ভদ্রলোক যিনি মিসেস রওশানের স্বামী, চোখ নাচিয়ে বললেন, “তোমার আলমারীর চাবি তোমার কাছে থাকে। তাই গয়নার সেট তুমি নিশ্চয়ই অন্য কোনোখানে রেখে ভুলে গেছ। এখন আমাদের দোষ দিচ্ছ।”
মিসেস রওশান গলা উচিয়ে বললেন, “আমি তোমার মত হাবাগোবা না যে ভুলে যাব।”
শওকত সাহেব এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখলি? তোরা দেখলি? তোর আম্মু আমাকে হাবাগোবা বলে গালি দিল।”
কম বয়সী একটা মেয়ে বলল, “বাদ দেও আব্বু। আগে চোর ধরার প্রজেক্ট শেষ হোক, যখন দেখবে আমরা কেউ আম্মুর গয়না চুরি করি নাই তখন হাইকোর্টে মানহানির মামলা করে দিবে।”
মোটাসোটা ভদ্রলোক খুশী খুশী হলে বললেন, “হ্যাঁ। সেইটাই তোর আম্মুর জন্য উচিৎ শিক্ষা হবে। দশ কোটি টাকার মানহানি মামলা।”
পেছন থেকে বাসার কাজ কর্মে সাহায্য করার একজন মহিলা চিকন গলায় বলল, “খালুজান, মামলায় টাকাটা কিন্তুক আপনারেই দিতে হবে।”
ডাইনিং রুমের সবাই হা হা করে হেসে উঠল। একজন বলল, “সত্যি কথা। একেবারে সত্যি কথা।”
মিসেস রওশান ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, “অনেক হয়েছে। ঢং বন্ধ করো। তোমরা ভেবেছ কী? চোর ধরা পড়লে আমি কী ছেড়ে দিব? ছাড়ব না। যাই হোক আমরা কাজ শুরু করি।” মিসেস রওশান ছোটাচ্চুকে দেখিয়ে বললেন, “ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ার হাসান। সাথে তার টিম মেম্বার ফারিহা। তাদেরকে আমি অনেক কষ্ট করে আমার এই কেসটা নিতে রাজী করিয়েছি।”
বিশ পচিশ বছরের একটা ছেলে বলল, “আমি ডিটেকটিভ শাহরিয়ার হাসানের উপর টেলিভিশনে একটা নিউজ দেখেছিলাম। অসাধারণ ডিটেকটিভ।”
মিসেস রওশানের মেয়ে বলল, “আমি জানতামই না আসলেই ডিটেকটিভ আছে। আমি ভেবেছিলাম খালি গল্প বইয়ে থাকে।”
শওকত সাহেব মাথা নেড়ে বলল, “অসাধারণ, অসাধারণ!”
ছোটাচ্চু বিব্রত ভঙ্গীতে বলল, “আসলে আমার নিজের কোনো ক্রেডিট নাই। আমার একটা খুব ভালো টিম ছিল। তাছাড়া এখন নানা ধরনের টেকনোলজি বের হয়েছে, আমাদের বিশেষ কিছু করতে হয় না। টেকনোলজি ব্যবহার করে সব কিছু করে ফেলা যায়।”
ছোটাচ্চু কথা শেষ করে তার হাতে টিস্যু দিয়ে ধরে রাখা একটা চাবি দেখিয়ে বললেন, “এই যে এটা হচ্ছে আলমারীর চাবি। এইটা ব্যবহার করে আলমারী খোলা হয়েছিল। কাজেই যে চুরি করেছে তার সিগনেচার এখানে আছে। জিনেটিক সিগনেচার। আমি একটু আগে একটা বিশেষ ক্যামিকেল দিয়ে এটা লেপে দিয়েছি। অপরাধীর জিনেটিক কোডিং এখন এই চাবিতে সিল হয়ে গেছে।”
সবাই মুখ গম্ভীর করে ছোটাচ্চুর কথা শুনতে থাকে। ছোটাচ্চু কেশে একটু গলা পরিস্কার করে বলল, “এখন আপনারা একজন একজন করে পাশের ঘরে যাবেন। সেখানে টেবিলের উপর চাবিটা রাখা থাকবে। আপনার চাবিটা মুঠো করে ধরে এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনবেন। তারপর চাবিটা রেখে দেবেন। আপনার জিনেটিক কোডিং যদি চাবিতে থাকা জিনেটিক কোডিংয়ের সাথে মিলে যায় তাহলে একটা রেজনেটিং এফেক্ট হবে।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “রেজনেটিং এফেক্ট মানে কী?”
“এটা একটা বৈজ্ঞানিক বিষয়। দুইটা জিনোমের ভিতর মিল থাকলে একটা আরেকটাকে এমপ্লিফাই করে অনেক বড় করে একটা সিগনাল দেয়। খালি চোখে আমরা দেখতে পাব না কিন্তু যদি জিনো ক্রিজিং মিটারে দেওয়া হয় সেই মেশিনটা বলে দেবে।”
মিসেস রওশনের মেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী মেশিন?”
“জিনো ক্রিজিং মিটার। আমাদের দেশে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে নতুন একটা এনেছে। সেখানে আমার এক বন্ধু কাজ করে, সে চেক করে দিতে রাজী হয়েছে। প্রতি স্যাম্পলে একশ ডলারের মত খরচ হয়, সে কম টাকায় করে দেবে।”
ছোটাচ্চু দেখল মিসেস রওশনের মেয়ে হাতের স্মার্ট ফোনে জিনো ফ্রিজিং মিটার খুজঁতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা বিপজ্জনক, কাজেই ছোটাচ্চু তাড়াতাড়ি বলল, “এটা খুবই নতুন টেকনোলজি, এখনো বেশী মানুষ এটা সম্পর্কে জানে না। তবে এটা চেক করার জন্য আলাদা করে সবার জিনেটিক স্যাম্পল দরকার হবে। যেমন সবার একটা করে চুল। কিংবা মুখের স্যালাইভা। কিংবা এক ফোটা রক্ত।”
মিসেস রওশনের স্বামী শওকত সাহেব নিজের টাক মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আমার এমনিতেই চুল নাই, যদি আরো চুল দিয়ে দেই—তাহলে থাকবে কী?’
ছোটাচ্চু হাসল। বলল, “একটা, মাত্র একটা চুল।”
“যার মাথায় চুল নাই তার কাছে প্রত্যেকটা চুল মূল্যবান।”
মিসেস রওশন ধমক দিয়ে বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন চুপ কর।” তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন বললেন, “তাহলে শুরু করে দিই?”
“ঠিক আছে।” ছোটাচ্চু বলল, “ও আচ্ছা। আরেকটা কথা। এই স্যাম্পল নিতে হয় অন্ধকারে। আলো থাকলে সিগন্যাল নষ্ট করে দেয়। তার কারণ আলো হচ্ছে ফোটন। ফোটন হচ্ছে শক্তির কণা। যখন কণা—”
শওকত সাহেব বললেন, “আমি বিজ্ঞানের কিছু বুঝি না। বিজ্ঞানের কথা শুনলে মাথা ধরে যায়।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে তাহলে ব্যাখ্যার করার চেষ্টা করছি না। চাবিটা থাকবে একটা ব্যাগের ভিতরে। ব্যাগটা ঢেকে রাখব একটা বড় তোয়ালে দিয়ে যেন আলো ঢুকতে না পারে। আপনারা ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা ধরে কিছুক্ষণ মুঠি করে রাখবেন। ঠিক আছে?”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
তখন ছোটাচ্চু বাইরের ঘরে গিয়ে টেবিলের উপর একটা ব্যাগ রেখে একটা টাওয়েল দিয়ে ঢেকে দিল। সবার প্রথম এলো বাসায় কাজ কর্মে সাহায্য করার মেয়েটি। তাকে এখন চা বানাতে হবে কাজেই তার একটু তাড়াহুড়া আছে।
ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সে হাত দিয়ে চাবিটা খুঁজতে থাকে। চাবিটা না পেয়ে বলল, “কই? ভেতরে তো চাবি নাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “ও আচ্ছা। সরি সরি। চাবিটা ভিতরে রাখতে ভুলে গেছি। আপনি হাতটা বের করেন, আমি চাবিটা রেখে দিই।”
কাজ কর্মে সাহায্য করার মেয়েটি হাত বের করে আনল, ছোটাচ্চু একটা টিস্যু দিয়ে ধরে ভেতরে চাবিটা রাখল। মেয়েটি চাবিটা ধরে দশ পর্যন্ত গুনে তার হাত বের করে আনল।
ছোটাচ্চু বলল, “চমৎকার। আপনার কাজ শেষ। আপনি এখন যেতে পারেন।”
ফারিহা তখন মেয়েটির মাথা থেকে একটু চুল নিয়ে একটা কাগজে স্কচ টেপ দিয়ে লাগিয়ে পাশে তার নামটা লিখে রাখল। এরপর এলো মিসেস রওশানের মেয়ে। সেও ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে চাবিটা খুঁজে পেল না। খানিকক্ষণ হাত দিয়ে খোঁজাখুজি করে বলল, “কোথায়? চাবিটা তো খুঁজে পাচ্ছি না।”
ঠিক আগের বারের মত ছোটাচ্চু বলল, “তাই নাকি? চাবি নাই?”
“নাহ!”
“ও আচ্ছা রাখতে ভুলে গেছি। হাতটা বের করো, আমি চাবিটা রাখছি ভিতরে।”
মেয়েটা হাত বের করল, ছোটাচ্চু টিস্যু দিয়ে ধরে চাবিটা ব্যাগের ভেতরে রাখল। এর পরে এলো পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একজন ছেলে। সেও ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে বলল, “কই? চাবি তো নেই ভেতরে।”
ছোটাচ্চু আবার আগের মতো বলল, “ও আচ্ছা! সরি। চাবিটা রাখতে ভুলে গেছি।”
এভাবে চলতে থাকে। ছোটাচ্চু ইচ্ছা করে কখনোই ভেতরে চাবিটা রাখে না আর সবাই চাবিটা খুঁজতে থাকে। যখন খুঁজে পায় না তখন ছোটাচ্চু চাবিটা ভেতরে রাখে।
পরপর সাতজন শেষ হওয়ার পর মিসেস রওশানের স্বামী শওকত সাহেব এলেন। তিনি ব্যাগের ভেতরে হাত ঢোকালেন। ভেতরে কোনো চাবি নেই কিন্তু তিনি কোনো কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ হাত মুঠি করে রেখে হাত বের করে আনলেন। ছোটাচ্চু যে ইচ্ছে করে ভেতরে কোনো চাবি রাখছে না সেটা তিনি জানেন না। কাজ শেষ করে যখন উঠে যাচ্ছিলেন ছোটাচ্চু তখন তাকে থামাল, নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “চাবিটা মুঠি করে ধরে রেখে দশ পর্যন্ত গুনেছেন?”
“হ্যাঁ গুনেছি।”
“চমৎকার।”
ছোটাচ্চু ফারিহার দিকে তাকাল, ফারিহা ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। তারা কী হাসবে নাকী কাঁদবে বুঝতে পারল না। বোঝাই যাচ্ছে মিসেস রওশানের স্বামী মিথ্যা কথা বলছেন, ব্যাগের ভেতর চাবি নেই, চাবিটা ধরে রাখলেন কীভাবে? শওকত সাহেব চলে গিয়ে পরের জন চলে এসেছিল ছোটাচ্চু তাকে একটু পরে আসতে বলে মিসেস রওশানকে ডেকে পাঠাল।
মিসেস রওশান এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “আমরা আপনার কেসটা ফিরিয়ে দিচ্ছি। এই কেসে কাজ করাটা ঠিক হবে না।”
মিসেস রওশান ভুরু কুঁচকে বললেন, “কাজ করা ঠিক হবে না?”
“নাহ্।”
“কেন?”
ছোটাচ্চু ফারিহার দিকে তাকালো, ফারিহাও ছোটাচ্চুর দিকে তাকালো কেউ কোনো কথা বলল না। মিসেস রওশান আবার জিজ্ঞেস করল, “কেন? কাজ করা ঠিক হবে না কেন? বের করতে পারবেন না?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না। বের করতে পেরেছি কিন্তু আপনাকে বলতে পারব না।”
“বের করেছেন?”
ছোটাচ্চু চুপ করে রইল। মিসেস রওশান অবশ্যি চুপ করে থাকার মানুষ নয়, আরো জোরে চিৎকার করে উঠলেন, “বলেন, কে? কে আমার গয়না চুরি করেছে?”
ছোটাচ্চু তবু চুপ করে রইল। তখন হঠাৎ করে মিসেস রওশান কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। ভুরু কুচকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “শওকত? নিশ্চয়ই শওকত। তাই না?”
ছোটাচ্চু চুপ করে রইল, অনেক কষ্ট করেও মুখের হাসিটা ঢেকে রাখতে পারল না।
মিসেস রওশান গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “শওকত! শওকত কোথায়? কতো বড় সাহস? আমার আলমারী খুলে আমার গয়নার সেট নিয়ে যাও—”
মিসেস রওশানের চিৎকার শুনে শওকত সাহেব এবং অন্য সবাই বসার ঘরে এসে ঢুকলো। এতো বড় একটা অপকর্ম করে হাতে নাতে ধরা পড়ার পরেও শওকত সাহেবের মুখে অপরাধের কোনো চিহ্ন নেই। বরং তার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়াংম্যান। কীভাবে বের করলে? ইউ আর এ জিনিয়াস। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করলে না তো?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না, না। আপনি তুমি করে বলতে পারেন। কিন্তু—”
“তুমি বের করলে কেমন করে? তোমার যন্ত্রপাতি তো এখানে নেই।”
“যন্ত্রপাতির ব্যাপারটা আসলে বানানো। ওসব কিছু না। ব্যাগের ভিতরে কোনো চাবি রাখিনি, কিন্তু আপনি বললেন চাবিটা হাত দিয়ে মুঠো করে ধরে রেখেছেন। তাই বুঝলাম—”
শওকত সাহেব আনন্দে হা হা করে হাসলেন। বললেন, “হাউ ক্লেভার।”
মিসেস রওশন রাগে তিড়বিড় করে জ্বলতে জ্বলতে বললেন, “হাউ ক্লেভার? তোমার লজ্জা করে না? বউয়ের গয়না চুরি করো—”
শওকত সাহেবকে খুব লজ্জা পেতে দেখা গেল না। হাসি হাসি মুখে বললেন, “বাবা। তোমাকে এই গয়না কিনে দিয়েছে কে? খামাখা আলমারীর ভিতর পড়ে থেকে ফাংগাস পড়ে যাচ্ছে।”
মিসেস রওশানের মেয়ে বলল, “আব্বু গয়না পাউরুটি না। গয়নায় ফাংগাস পড়ে না।”
মিসেস রওশানের রাগ কমার কোনো লক্ষন দেখা গেল না। হুংকার দিয়ে বললেন, “তুমি পুরুষ মানুষ তোমার গয়নার দরকার পড়ল কেন? কী করেছ আমার গয়না?”
“দিয়ে দিয়েছি।”
“কাকে দিয়েছ?”
“ঐ যে আগুনে পুড়ে একটা ফেমিলির সবাই মরে গেল। শুধু একটা মেয়ে বেঁচে গেছে। তার বিয়ে—”
মিসেস রওশানের রাগ একটু কমে এলো। বললেন, “তাকে গয়না দিতে চাও সেটা আমাকে বললে না কেন? আমি কি না করতাম?”
“ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তোমাকে ডিস্টার্ব করতে চাই নাই।”
মিসেস রওশান নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এর পরের বার থেকে আমাকে বলে কয়ে দেখবে।”
শওকত সাহেব মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঠিক আছে।”
তাদের মেয়ে না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “না আম্মু। আব্বু আসলে গয়না দুই চোখে দেখতে পারে না। পেলেই সেগুলো এদিক সেদিক দিয়ে দেয়। আম্মু, তুমি যদি তোমার গয়না বাঁচাতে চাও তাহলে ব্যাংকের সেফ ডিপোজিট বক্সে নিয়ে রাখো।”
মিসেস রওশান মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ, এখন থেকে সেইটাই করতে হবে।”
শওকত সাহেব লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “খামাখা গয়না বাঁচিয়ে কী লাভ? কোনো একদিন আসল কোনো চোর এসে চুরি করে নিয়ে যাবে! এর থেকে একটা কাজে লাগুক—”
মিসেস রওশান বললেন, “থাক। আর লেকচার দিতে হবে না।”
উত্তেজনা আস্তে আস্তে কমে এসেছে। তখন ছোটাচ্চু বলল, “আমরা তাহলে এখন যাই?”
মিসেস রওশান বললেন, “একটু চা খেয়ে যান।”
“না, না, চা খেতে হবে না। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। আপনাদের সাথে পরিচয় হল, আরেকদিন এসে চা খেয়ে যাব।”
বিদায় নিয়ে গাড়ীতে ওঠার সময় মিসেস রওশান ছোটাচ্চুকে একটা খাম ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ছোটাচ্চু অবশ্য কিছুতেই খামটা নিতে রাজী হলো না। শওকত সাহেব তখন ছোটাচ্চুর টেলিফোন নম্বরটা রেখে দিলেন, তার কোম্পানীর কাজে নাকী সাহায্য করার জন্য ছোটাচ্চুকে ডাকবেন।
গাড়ীটা ছেড়ে দেবার পর ফারিহা বলল, “খামটা অনেক মোটা ছিল।”
“হ্যাঁ। অনেক মোটা। নোটগুলো কী পাঁচশ টাকার ছিল, নাকি হাজার টাকার?
“মনে হল সব হাজার টাকার নোট।”
ছোটাচ্চু জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “ইশ! এতোগুলো টাকা।”
“হ্যাঁ। এতোগুলো টাকা!”
ছোটাচ্চু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, “আমার জিনো ক্রিজিং মিটারের গল্পটা কেমন হয়েছিল?”
“ভালো, অনেক ভালো। চাপাবাজিতে তুমি অনেক এক্সপার্ট। এখন নূতন একটা এজেন্সি খুলো, দা আল্টিমেট চাপাবাজি এজেন্সি!”
ছোটাচ্চু তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল।

এপ্রিল ২০১৯

জাল নোট


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

জানালার পাশে দাড়িয়ে টুম্পা দেখল তাদের বাসার সামনে একটা সাদা গাড়ী এসে থেমেছে। গাড়ীটার পিছনে একটা পুলিশের ভ্যান, সেখানে অনেক পুলিশ। সাদা গাড়ীটা থেকে একজন মানুষ নামল, সে এদিক সেদিক তাকালো তারপর তাদের বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। কয়েক মিনিট পরেই দরজায় টুং টাং বেল শোনা গেলো।
টুম্পা ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে দেখলো ছোটাচ্চু বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের কোম্পানী থেকে নিজের চাকরী যাওয়ার পর থেকে ছোটাচ্চু বেশীর ভাগ সময় এইভাবে শুয়ে থাকে।
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু বাসার সামনে একটা পুলিশের গাড়ী থেমেছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “গুড।”
“একজন মানুষ আমাদের বাসায় ঢুকেছে।”
ছোটাচ্চু উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ভেরি গুড।”
“মনে হয় তোমার কাছে এসেছে।”
“ভেরি ভেরি গুড।”
“তুমি যাবে না দেখা করতে?”
ছোটাচ্চু এবারে টুম্পার দিকে তাকালো তারপর বলল, “কী বললি?”
“বলেছি তুমি দেখা করতে যাবে না?”
“কার সাথে দেখা করতে যাব না?”
“তুমি আমার কথা শুনোনি?”
ছোটাচ্চু পালটা জিজ্ঞেস করল, “তুই কি আমাকে কিছু বলেছিস?”
“হ্যাঁ, বলেছি, তুমি কিছুই শুনোনি।” টুম্পা কী বলেছে সেটা আবার বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই শান্ত এসে বলল, “ছোটাচ্চু তোমার সাথে ডি.এম.পি.র পুলিশ কমিশনার দেখা করতে এসেছে।”
ছোটাচ্চু বিছানা উঠে বসে বলল, “আমার কাছে? আমার কাছে কেন?”
শান্ত বলল, “তুমি কোনো ক্রাইম করেছ?”
“আমি কেন ক্রাইম করব?”
“ক্রাইম করে থাকলে বলতাম তোমাকে এরেস্ট করতে এসেছে। না করলে কেন এসেছে আমি জানি না।”
ছোটাচ্চু আজকাল দাড়ি কাটে না তাই তার মুখে খোচা খোচা দাড়ি। ছোটাচ্চু গালে হাত বুলিয়ে বলল, “এই ভাবে যাব?”
শান্ত বলল, “হ্যাঁ। মুখে বিন্দি বিন্দি দাড়ি থাকা হচ্ছে স্টাইল। পুলিশ কমিশনার মনে করবে তুমি স্টাইলিস্ট।”
ছোটাচ্চু তাই সেভাবেই গেল, বাইরের ঘরে পুলিশ অফিসার ছোটাচ্চুকে দেখে উঠে দাড়াল। ছোটাচ্চুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব?”
“জী।” বলে ছোটাচ্চু হাত মিলিয়ে সোফায় বসে পড়ল। পুলিশ অফিসার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমরা একটা কাজে আপনার কাছে এসেছি।”
“আমার কাছে?”
“জী। আমরা আসলে প্রথমে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাছে গিয়েছিলাম।”
ছোটাচ্চু তখন সোজা হয়ে বসল, বলল, “তাই নাকী?”
“জী। দেখলাম নতুন ম্যানেজমেন্ট, কিন্তু সেখানে আপনি নাই।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি নাই।”
“আপনার নিজের হাতে তৈরি করা কোম্পানী কিন্তু আপনি কেন নাই বুঝতে পারলাম না।”
ছোটাচ্চুর বলতে লজ্জা লাগলো যে তাকে তার নিজের কোম্পানি বের করে দিয়েছে, সেই জন্যে নাই। তাই জোর করে চেষ্টা করে মুখটা হাসি হাসি বানিয়ে বসে রইল। পুলিশ অফিসার বলল, “প্রথমে ভেবেছিলাম আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর সাথেই আলাপ করি কিন্তু পরে মনে হলো যেখানে আপনি নাই সেই কোম্পানীর সাথে আলাপ করে লাভ নাই।”
ছোটাচ্চুর চোখে মুখে এবারে একটু উত্তেজনা দেখা দিল, বলল, “তাই ভাবলেন?”
“জী। সেইজন্যে আমরা খোঁজাখুজি করে আপনার কাছে চলে এসেছি।”
ছোটাচ্চু এবারে আরেকটু উত্তেজিত হল। বলল, “আচ্ছা!”
“আপনার একটু সাহায্য দরকার।”
“আমার?”
“হ্যাঁ, আপনার।”
ছোটাচ্চু তার বিন্দি বিন্দি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, “কিন্তু, আমি ভেবেছিলাম ডিটেকটিভের কাজ ছেড়ে দেব।”
“সেকী?” পুলিশ অফিসার বলল, “আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে অনেক সময় আগাতে পারি না, একটা বৃত্তের মাঝে আটকা পড়ে যাই। তখন আপনাদের মত ব্রিলিয়ান্ট এনলিটিক্যাল ডেটিকেটেড, থরো আর কমপ্রিহেনসিভ ইনভেস্টিগেশন যারা করে তাদের সাহায্যে যদি না পাই—”
ছোটাচ্চু তার নিজের সম্পর্কে বলা এই পাঁচটা ইংরেজি বিশেষণ মনে রাখার চেষ্টা করল, ব্রিলিয়ান্ট, এনলিটিক্যাল, ডেডিকেটেট, থরো এবং কমপ্রিহেনসিভ। কী অসাধারণ!
পুলিশ অফিসার বলল, “আপনি প্লিজ না করতে পারবেন না। আমাদেরকে হেল্প করেন—”
ছোটাচ্চু একটা ভাব নিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে, আগে বলেন শুনি। দেখি হেল্প করতে পারি কী না।”
পুলিশ অফিসার এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “ব্যাপারটা খুবই গোপনীয় এটা এখন শুধু আপনার আর আমার মাঝে থাকবে। আর কেউ যেন জানতে না পারে।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “জানবে না।”

অবশ্যি ছোটাচ্চু জানতো না বসার ঘরে জানালার নিচে বাসার প্রায় সব বাচ্চা মাথা নিচু করে ছোটাচ্চুর সাথে পুলিশ অফিসারের কথাবার্তা শুনছিল। এই অতি গোপনীয় আলাপটা বাচ্চারা সবাই খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনল।
পুলিশ অফিসার ছোটাচ্চুকে যেটা জানাল সেটা সংক্ষেপে এরকম: দেশে জাল নোটের একটা সমস্যা সবসময়েই ছিল কিন্তু সবসময়েই সেই জাল নোট হতো পাঁচশ কিংবা হাজার টাকার। কিন্তু এখন খুবই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটেছে। দশ টাকার জাল নোটে বাজার ভরে গেছে। পাঁচশ টাকা কিংবা হাজার টাকার জাল নোট একজনকে গছিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন, ভালো করে যাচাই বাছাই না করে এই বড় নোট কেউ নেয় না। দশ টাকার জাল নোটের বেলায় সেটা সত্যি নয়, মানুষ চোখ বন্ধ করে দশ টাকার নোট নিয়ে নেয়, সেটা পরে জাল নোট বের হলেও সেটা নিয়ে কেউ বেশি বিচলিত হয় না। বরং অনেক সময় এই জাল নোট নিয়ে হাসি তামাশা করে। তাই যারা দশ টাকার জাল নোট বের করে তারাও মোটেও যত্ন নিয়ে জাল নোট তৈরি করে না, একেবারে ফটোকপি করার মত করে জাল নোট তৈরি করে—খুবই সস্তায়। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই দলটাকে ধরতে পারছে না। তাই তারা ছোটাচ্চুর কাছে এসেছে কীভাবে ধরা যায় সেটার একটা বুদ্ধি নেওয়ার জন্যে।
সবকিছু শুনে ছোটাচ্চু বলল যে সে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখবে, তারপর জানাবে। পুলিশ অফিসার খুব খুশী হয়ে ছোটাচ্চুকে কিছু কাগজপত্র দিয়ে চা নাস্তা খেয়ে চলে গেল।

ছোটাচ্চু পুলিশ অফিসারের সাথে কথা শেষ করে যখন বাসার ভিতরে এলো তখন তার মুখ বেশ হাসি হাসি। বাচ্চারা ততক্ষণে দাদীর কাছে চলে এসে টেলিভিশন দেখার ভাণ করছে। ছোটাচ্চুকে দেখে টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু, পুলিশ অফিসার তোমাকে কী বলেছে?”
“একটা কেস নিয়ে এসেছে।”
“তুমি না ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দিয়েছ?”
“ছেড়েই তো দিয়েছিলাম কিন্তু এমনভাবে ধরেছে না করতে পারলাম না!”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী কেস ছোটাচ্চু?”
“সেটা বলা যাবে না। খুবই গোপনীয়।”
“বল না আমাদেরকে, প্লীজ।”
“উহুঁ।” ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “বলা যাবে না।”
সবাই মুখ টিপে হাসল, ছোটাচ্চু সেটা লক্ষ করল না। কিছুক্ষন টেলিভিশন দেখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল, মনে হল পুলিশ অফিসার যে ফাইলটা দিয়ে গেছে সেটা দেখছে। অনেকদিন পর ছোটাচ্চুর ভেতরে একধরনের উৎসাহ ফিরে এসেছে।

পরদিন বিকালে সব বাচ্চারা একসাথে বসেছে, টুনি সবাইকে ডেকে এনেছে। যখন সবাই গোল হয়ে বসেছে তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু এখন বাসায় নাই তাই আমি তোমাদের সবাইকে ডেকেছি।”
একজন জিজ্ঞেস করলো, “কেন?”
“ছোটাচ্চুকে যখন তার কোম্পানী থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে তখন ছোটাচ্চুর খুব মন খারাপ হয়েছে।”
প্রমি বলল, “মন খারাপ হতেই পারে। নিজের কোম্পানী থেকে কখনো কেউ বরখাস্ত হয়?”
শাহানা বলল, “স্টীভ জবস হয়েছিল।”
প্রমি বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চু তো স্টীভ জবস না।”
শান্ত বলল, “ছোটাচ্চু হচ্ছে বোকা সোকা মানুষ। সহজ সরল মানুষ।”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমার ভিতরে অনেক প্যাঁচ সেজন্যে তোমার কাছে সবাইকে মনে হয় বোকা সোকা সহজ সরল।”
শান্ত বলল, “শব্দটা প্যাঁচ না, শব্দটা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা। ইন্টেলিজেন্স।”
প্রমি বলল, “খামোখা বাড়তি কথা বলে লাভ নাই। কী জন্যে ডেকেছিস সেইটা বল।”
টুনি বলল, “আমরা সবাই কালকে লুকিয়ে লুকিয়ে পুলিশ অফিসার আর ছোটাচ্চুর কথা শুনেছি।”
মুনিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, “কাজটা ঠিক হয় নাই। কারো গোপন কথা শুনতে হয় না।”
শান্ত বলল, “বড় বড় কথা বলবি না, দিব একটা থাবড়া।”
মুনিয়া তখন চুপ করে গেল।
টুনি বলল, “পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলেছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। ছোটাচ্চুর খুব মন খারাপ, যদি এই কেসটা সলভ করতে পারে তাহলে ছোটাচ্চুর মনটাও ভালো হয়ে যাবে, ছোটাচ্চু আবার আগের মত বাসায় বসে বসে কাজ করতে পারবে। একটা ইনকামও হবে।”
শাহানা বলল, “সেইটা তো বুঝলাম কিন্তু আজকে সবাইকে তুই কেন ডেকেছিস?”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু নিজে নিজে এই কেস সলভ করতে পারবে না। আমাদের ছোটাচ্চুকে সাহায্য করতে হবে।”
“আমাদের? আমরা কীভাবে সাহায্য করব?”
টুনি তখন তার হাতে ধরে রাখা ফাইলটা খুলে বলল, “পুলিশ অফিসার যে ফাইলটা দিয়ে গেছে সেটা নিয়ে এসেছি। পুলিশ যা যা জানে সেটা এখানে লেখা আছে।”
“কী লেখা আছে, দেখি?” বলে সবাই এগিয়ে এল।
টুনি ফাইলটা দেখালো, বলল, “জাল নোটের নম্বর দেয়া আছে। ছয়টা আলাদা নম্বর। সবসময় ঘুরে ফিরে এই ছয়টা নম্বরই আসে।”
শাহানা বলল, “ছয়টা?”
টুনি বলল, “হ্যাঁ। আর কয়েকটা জাল নোটও দিয়েছে দেখার জন্যে।”
“দেখি দেখি” বলে সবাই নোটগুলো দেখার জন্যে ঝুকে পড়ে। শাহানা একটা নোট হাতে নিয়ে অনেক খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো, হাতে ধরে আলোর বিপরীতে রেখে পরীক্ষা করল, তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “রঙ্গীন লেজার প্রিন্টারে প্রিন্ট করেছে। সাইজটা ভালো করে কাটে নাই পর্যন্ত।”
টুনি বলল, “একটা এ ফোর কাগজে ছয়টার বেশী দশ টাকার নোট প্রিন্ট করা যায় না। সেইজন্যে খালি ছয়টা নম্বর।”
শান্ত বলল, “এত সোজা? তাহলে আমরা জাল নোটের বিজনেস শুরু করি না কেন?”
টুনি বলল, “সেইজন্যে তোমাকে ডেকেছি শান্ত ভাইয়া।”
“সেইজন্যে আমাকে ডেকেছিস মানে?”
“যারা জাল নোট তৈরি করে তারা ব্যবসাটা কীভাবে করে সেটা তোমার কাছ থেকে বোঝার জন্যে।”
শান্ত চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস?”
টুনি শান্ত গলায় বলল, “ধরা যাক, তোমার একটা রঙ্গীন লেজার প্রিন্টার আছে, তুমি দশ টাকার জাল নোট তৈরি করো। তৈরি করার পর ধরা না পড়ে বাজারে ছাড়বে কেমন করে?”
শান্ত একটু রেগে বলল, “সেইটা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
টুম্পা বলল, “শান্ত ভাইয়া আমাদের মাঝে তুমি সবচেয়ে বেশী দুই নম্বুরী, সেইজন্যে টুনি আপু তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে। তাই না টুনি আপু?”
টুনি মাথা নাড়ল, তখন শান্ত বলল, “দেব একটা থাবড়া।”
শাহানা বলল, “এতো রাগ হচ্ছিস কেন? একটু চিন্তা করে বল আমাদের! তোকে তো কেউ ক্রিমিনাল বলছে না, বলছে তুই ক্রিমিনালদের মতো চিন্তা করতে পারিস!”
প্রমি বলল, “হ্যাঁ, ক্রিমিনালদের মত চিন্তা করলে কেউ ক্রিমিনাল হয় না।”
টুনি বলল, “এটাকে ক্রাইম ফ্যান্টাসীও বলতে পার।”
শান্ত তখন একটু শান্ত হলো। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “বড় জাল নোট একটা গছাতে পারলেই অনেক লাভ। দশ টাকার জাল নোটে সেই রকম লাভ নাই। তাই অনেকগুলো জাল নোট একসাথে ব্যবহার করতে হবে। সেই জন্যে মার্কেটিং করার জন্যে অনেক মানুষ দরকার। কিন্তু মানুষ বেশী হলে ধরা পড়ার চান্স বেশী। তাই মার্কেটিং করতে হবে খুব কায়দা করে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী রকম?”
“টোকাই বাচ্চাদের ব্যবহার করা সহজ, তারা জানবেও না—আমি তাদের জাল নোট দিয়ে দিয়ে বলব সেগুলো দিয়ে কিছু একটা কিনে আনতে! চকলেট, ক্লিপ, পেন্সিল, কলম, ফিতা, সেফটিপিন! তারপর সেই জিনিসগুলো সস্তায় পাইকারী বিক্রি করব।”
শাহানা বলল, “ওয়ান্ডারফুল, তুই বড় হলে ঘাঘু ক্রিমিনাল হতে পারবি!”
টুম্পাকে জানালার কাছে দাড়া করিয়ে রাখা হয়েছিল সে এরকম সময়ে ছুটে এসে বলল, “ছোটাচ্চু আসছে! ছোটাচ্চু আসছে!”
সাথে সাথে সবাই উঠে দাড়াল, টুনি ফাইলটা নিয়ে ছুটে গেলো ছোটাচ্চুর ঘরে সেখানে রেখে আসার জন্যে। আজকের মিটিং মোটামুটি এখানেই শেষ।

ছোটাচ্চু যখন বাসায় থাকে না তখন বাচ্চারা মিলে আরো কয়েকবার মিটিং করলো এবং সবাই মিলে চিন্তাভাবনা করে মোটামুটি কীভাবে তদন্ত করা যায় সেটা ঠিকও করে ফেলল। কিন্তু সেটা কীভাবে ছোটাচ্চুকে বলবে তারা বুঝতে পারছিল না, তখন ভেবেচিন্তে তারা শেষ পর্যন্ত একটা পথ বের করল।
সেদিন রাত্রি বেলা যখন ছোটাচ্চু এসেছে তখন বাচ্চারা ছোটাচ্চুকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। প্রথমে মুনিয়া বলল, “চল, আমরা চোর পুলিশ খেলি।”
টুম্পা বলল, “নাহ এটা খুবই পানশে খেলা। এটা খেলব না।”
“তাহলে কী খেলবে?”
শান্ত বলর, “আয়, ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল খেলি।”
“সেটা কীভাবে খেলে?”
“আমরা একজন একজন করে ক্রিমিনাল হয়ে ক্রাইম করব, অন্যেরা হবে ডিটেকটিভ, তারা ক্রিমিনালকে ধরবে।”
মুনিয়া বলল, “ঠিক আছে। প্রথমে কে ক্রিমিনাল হবে?”
শান্ত বলল, “আমি।”
টুম্পা বলল, “তুমি কী করবে?
“মার্ডার!”
“ঠিক আছে মার্ডার করো।”
শান্ত বলল, “এক জনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ছাদে নিয়ে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেব। তার হাড্ডিগুড্ডি গুড়া হয়ে যাবে, মাথার ঘিলু বের হয়ে যাবে, পুরা শরীর থেতলে যাবে—”
তখন দাদী ধমক দিয়ে বললেন, “কী বলছিস এইসব?”
“খেলছি দাদী।”
“এইটা একটা খেলা হল? বন্ধ কর এই খেলা।”
টুম্পা বলল, “ঠিক আছে। মার্ডার করার দরকার নাই। অন্য ক্রাইম করো।”
শান্ত বলল, “আসলে আমি মার্ডার করার এক্সপার্ট। অন্য ক্রাইম পানশে লাগে!”
“পানশে লাগলে লাগুক। অন্য ক্রাইম করো।”
শান্ত খানিক্ষন চিন্তা করার ভান করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, তাহলে নোট জাল করব।”
সবাই চোখের কোনো দিয়ে দেখল শান্তর কথা শুনে ছোটাচ্চু কেমন জানি সোজা হয়ে বসল।
শান্ত বলল, “আমি নোট জাল করতে শুরু করেছি। সবাই পাঁচশ আর এক হাজার টাকার নোট জাল করে, আমি শুরু করেছি দশ টাকার জাল নোট!”
এবারে ছোটাচ্চুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, বিস্ফোরিত চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি বলল, “দশ টাকার নোট জাল করে তোমার পোষাবে না।”
“একশবার পোষাবে।” শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমি মার্কেটিং করব টোকাইদের দিয়ে। তাদেরকে দশ টাকার জাল নোট দিয়ে বলব কিছু একটা কিনে আনতে।”
টুম্পা বলল, “কিন্তু তুমি জাল নোট বানাবে কেমন করে?”
“খুবই সোজা। রঙ্গীন লেজার প্রিন্টারে জাল নোট ছাপাব। একটা এ ফোর কাগজে ছয়টা এঁটে যাবে।”
“তার মানে শুধু ছয়টা নম্বরের জাল নোট হবে?”
“হ্যাঁ। সমস্যা কী? কেউ কখনো নোটে কী নম্বর আছে দেখে না।”
ছোটাচ্চু তখন মুখ হা করে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, শান্ত বলল, “তোরা কেউ আমাকে ধরতে পারলি না। আমি হচ্ছি ক্রিমিনালদের সেরা। এক নম্বর ক্রিমিনাল!”
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমাকে ধরা খুবই সোজা।”
“কীভাবে ধরবি।”
“লেজার প্রিন্টারে খুবই সুন্দর রঙ্গীন ছাপা হয় সত্যি—কিন্তু সেই প্রিন্টারের কার্টিজের দাম অনেক বেশী। সব জায়গাতে পাওয়া যায় না।”
“তাতে সমস্যা কী?”
“সমস্যা হচ্ছে, ঢাকা শহরে মাত্র অল্প কিছু দোকানে রঙ্গীন লেজার প্রিন্টারের টোনার পাওয়া যায়। আমি সেই দোকানগুলোতে খোঁজ নিব, দেখব কে মাঝে মাঝেই এতো দামী টোনার কিনছে। তাহলেই তুমি ধরা পড়ে যাবে—”
সবাই দেখলো ছোটাচ্চু হঠাৎ কেমন জানি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল, তারপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।
বাচ্চারাও তখন ছোটাচ্চুর পিছু পিছু গেল। ছোটাচ্চু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই ফোনে একজনের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। বাচ্চারা দরজায় কান লাগিয়ে শুনল ছোটাচ্চু বলছে, “কমিশনার সাহেব, জাল নোট ওয়ালাদের ধরার খুব সহজ একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে। রঙ্গীন লেজার প্রিন্টারের টোনার যারা বিক্রি করে তাদের দোকানে যদি চোখ রাখা যায়…. ”
বাচ্চারা মুখে হাত দিয়ে খিক খিক করে হাসতে হাসতে সরে এলো।

দুইদিন পর রাত্রিবেলা দাদীর ঘরে সবাই বসে আছে তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকলো। হাতে বিশাল একটা কেক। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “কেক! কেক!”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেক কেন এনেছ ছোটাচ্চু!”
ছোটাচ্চু বলল, “মনে আছে পুলিশ কমিশনার কয়দিন আগে একটা কেস নিয়ে এসেছিল?”
“হ্যাঁ ছোটাচ্চু, মনে আছে।”
“সেই কেসটা সলভ করেছি।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। বিশাল একটা গ্রুপকে এরেস্ট করা হয়েছে।”
সবাই তখন আনন্দের মত শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেসটা কী ছিল ছোটাচ্চু? আমাদের বলবে?”
“না।” ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “বলা যাবে না। এটা খুবই গোপনীয়।”

ফিরে এলো ছোটাচ্চু

ফিরে এলো ছোটাচ্চু


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

দাদী (কিংবা নানী) বসে টেলিভিশনে একটা বাংলা সিরিয়াল দেখছেন, কাহিনী খুব জমে উঠেছে, শ্বাশুরী বউকে বাড়ী থেকে বের করে দিচ্ছে, ছেলে প্রতিবাদ না করে মুখ বন্ধ করে বসে আছে। সেই দৃশ্য দেখে দাদী অপদার্থ ছেলেটির উপর খুবই রেগে উঠছেন। কিন্তু তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন না কারণ খুব কাছেই বাচ্চারা হুটোপুটি করে খেলতে খেলতে চিৎকার করছে। দাদী একটা হুংকার দিয়ে বললেন, “এই! তোরা থামবি? তোদের যন্ত্রণায় এক মিনিট টেলিভিশনটাও ঠিক করে দেখতে পারি না।”
পাশেই বসে ঝুমু খালা দাদীর পায়ে গরম তেল মাখিয়ে দিচ্ছিল। গরম তেলে কী দিয়েছে কে জানে, দাদীর শরীর থেকে শিক কাবাবের মত এক ধরনের গন্ধ বের হচ্ছে। দাদীর হুংকারের পর সেও একটা হুংকার দিল, “তোমরা কী চিল্লা ফাল্লা থামাবা নাকী জরিনি বেওয়ার পানি পড়া নিয়া আসুম?”
বাচ্চারা চিৎকার থামিয়ে ঝুমু খালার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। জরিনি বেওয়ার নাম তারা আগেও ঝুমু খালার কাছে শুনেছে, তার নানারকম রহস্যজনক কাজকর্মের কথাও শুনেছে, পানি পড়া দিয়ে কী হয় সেটা এখনো শুনেনি, তাই একজন জিজ্ঞেস করল, “জরিনি বেওয়ার পানি পড়া দিয়ে কী হবে?”
ঝুমু খালা বলল, “খালি তোমাদের শরীরে একটা ছিটা দিমু ব্যস কথা বন্ধ। নো চিল্লা নো ফাল্লা।”
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা নাকী? আমাগো গ্রামে দবির মিয়া হইল ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত। মার্ডার কেসের আসামী, যখন কোর্টে মামলা উঠছে তখন হে জরিনি বেওয়ার এক শিশি পানি পড়া নিয়া গেছে। জজ সাহেব ঠিক যখন রায় দিব তখন জজ সাহেবের দিকে পানি পড়া ছিটায়ে দিছে! ব্যাস— জজ সাহেবের জবান বন্ধ। দবির মিয়া বেকসুর খালাস।”
সবচেয়ে ছোটজন রিন রিনে গলায় জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
ঝুমু খালা বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা নাকী? আমাগো গ্রামে চল, দবির মিয়ারে দেখামু। এখনো ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইত।”
আরেকজন বলল, “আমাকে এক শিশি পানি পড়া এনে দেবে?”
ঝুমু খালা জানতে চাইল, “কী করবা?”
“আমাদের স্কুলে বিলকিস মিসের গায়ে ছিটা দিব।”
“কেন?”
“ক্লাসে বড় জ্বালায়। ক্যাট ক্যাট করে খালি বকা দেয়।”
তখন সবাই এক সাথে হই হই করে উঠল, “আমাকে এক শিশি—আমাকে এক শিশি—”
শান্ত বলল, “আমাকে এক বালতি।”
সবাই ঘুরে শান্তর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এক বালতি? এক বালতি দিয়ে কী করবে?”
শান্ত হাসি হাসি মুখে বলল, “বিজনেস! ছোট ছোট শিশিতে ভরে বিক্রি করব। এক শিশি একশ টাকা!”
শান্ত কিভাবে জরিনি বেওয়ার পানি পড়া দিয়ে বিজনেস করবে সেটা শোনার আগেই সবাই দেখল ঘরে ছোট চাচা ঢুকছে। তার মুখ হাসি হাসি এবং হাতে একটা ব্যাগ।
সবাই হই হই করে উঠল, “ছোটাচ্চু, কী এনেছ? কী এনেছ?”
ছোটাচ্চুর মুখের হাসি আরো বড় হলো, বলল, “ফাটাফাটি জিনিস। এক দ্যাখ—” তারপর ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা মোটা বই বের করে আনল। চকলেটের বাক্সের বদলে একটা বই তাও সেটা ইংরেজিতে লেখা, দেখেই সবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এবং একসাথে সবাই মিলে যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল। ছোটাচ্চু সেটা খেয়াল করল বলে মনে হল না, বইটা উপরে তুলে বলল, “এই হচ্ছে সেই বই। মাদার অব অল বুকস।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “ইংরেজি বই?”
ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ।”
“তুমি ইংরেজি বই পড়বে।”
ছোটাচ্চু একটু রেগে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ, পড়ব। কোনো সমস্যা আছে?”
শান্ত বলল, “তুমি বাংলাই ভালো করে জানো না ইংরেজি বই কেমন করে পড়বে?”
ছোটাচ্চু হুংকার দিল, “আমি বাংলা জানি না?”
শান্ত বলল, “মনে নাই, আমি গোসল করব না বলে তুমি বল, আমি গোসলাব—”
“বলি না। আমি কোনোদিন গোসলাব বলি না।”
“বলেছ। দাদী বলেছে।” শান্ত তখন তার দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদী, মনে আছে তুমি বলেছিলে ছোটাচ্চু ছোট থাকতে বলতো আমি গোসলাব, বলত না দাদী?”
দাদী তার সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। শ্বাশুড়ি এখন বাড়ীর বউয়ের চুল ধরে টানাটানি করছে, শান্তর কথা শোনার সময় নাই, তাই মাথা ঝাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ বলত।”
শান্ত রাজ্য জয় করার ভঙ্গী করে বলল, “দেখেছ?”
“ছোট থাকতে কে কী বলে তার ঠিক আছে?”
শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “কারো যদি সমস্যা থাকে সেটা ছোট থাকতেই বোঝা যায়।”
মুনিয়া হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, ছবি আছে বইয়ে?”
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “ছবি? ছবি দিয়ে কী হবে?”
“ছবি নাই?”
“না—মানে, এইটাতো পোলাপানের বই না যে ছবি থাকবে। এটা হচ্ছে কাজের বই।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ?”
“এই তো কীভাবে বিজনেস বড় করতে হয়। ম্যানেজমেন্ট এফিসিয়েন্ট করতে হয়। প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হয়—”
একজন কানে হাত দিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ ছোটাচ্চু তুমি এই খারাপ খারাপ কথাগুলো বলো না, শুনলে গা শির শির করে।”
আরেকজন বলল, “ছোটাচ্চুর কথা শুনে লাভ নাই। চকলেটের বাক্স আনলে একটা কথা ছিল। আয় খেলি।” বলে সবাই খেলায় ফিরে গেল।
ছোটাচ্চু বইটা উপরে তুলে ধরেছিল এবারে মন মরা হয়ে বইটা নিচে নামিয়ে বলল, “তোদের হয়েছেটা কী? দিনরাত খাই খাই করিস। চকলেট না আনলে কথাই শুনতে চাস না।”
কেউ ছোটাচ্চুর এই কথাটাও শুনল বলে মনে হয় না, সবাই হই চই করে খেলতে থাকলো, দাদী একটু পরে আবার হুংকার দিলেন, “এই তোরা থামবি? থামবি একটু?”

ছোটাচ্চু যখন তার ঘরে গিয়ে জুতো খুলে বিছানায় বসেছে তখন টুনি গিয়ে ঢুকলো, ছোটাচ্চু তাকে এক নজর দেখে বলল, “কী হলো, কিছু বলবি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
“তাহলে?”
“তুমি যেটা বলতে চাইছিলে সেটা শুনতে এসেছি।”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কিছু বলতে চাই নাই। তোদের মত পোলাপানদের সাথে আমি কী বলব?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “ছোটাচ্চু তোমার মুখ দেখেই সব কিছু বোঝা যায়। আজকে কিছু একটা হয়েছে সেজন্যে তুমি খুব উত্তেজিত। তুমি কিছু একটা বলতে চাচ্ছ। কী হয়েছে বল।”
“কিছু হয় নাই।”
“ছোটাচ্চু তুমি এই রকম মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়ার মানুষ না—তোমাকে কেউ একজন কিছু একটা বলেছে। কে বলেছে? কী বলেছে?”
ছোটাচ্চু টুনির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল এবং ধীরে ধীরে তার মুখে আবার হাসি ফিরে এলো, বলল, “আজকে আমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছিল। তার নাম হচ্ছে সরফরাজ কাফি।”
“এটা আবার কী রকম নাম?”
“নাম তো নামই। স্কুলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের নাম ছিল মাগরা মাহিন্দি। যাই হোক সরফরাজ রীতিমত এপয়ন্টমেন্ট করে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। এসে কী বলল জানিস?”
“কী বলল?”
“বলেছে আমার দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির ভবিষ্যৎ একেবারে ফাটাফাটি। এটাকে ঠিকমত মার্কেটিং করতে পারলে—”
টুনি ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “মার্কেটিং? মানে বেচা-কেনা?”
“আরে না, আলু পটল বেচার মত মার্কেটিং না। অন্য রকম মার্কেটিং। ব্রান্ডিং করা। সবাইকে জানানো—”
“সরফরাজ কাফি আর কী বলেছে?”
“বলেছে আমার এজেন্সির সব ঠিক আছে শুধু ম্যানেজমেন্ট দুর্বল। ম্যানেজমেন্ট ঠিক করতে পারলে ধাঁই ধাঁই করে উঠে যাবে।
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তোমাকে গায়ে পড়ে অপমান করে গেল আর তুমি কিছু বললে না?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “আরে ধুর। গায়ে পড়ে অপমান কেন হবে? নিজ থেকে আমাকে সাহায্য করতে চাইল। এতো গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ—”
“গুরুত্বপূর্ণ? তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে ফালতু টাইপ।”
“না, না কী বলিস। ফালতু কেন হবে। তাদের বিশাল বড় ফার্ম, নূতন নূতন কোম্পানীকে দাড়া করিয়ে দেয়। আমাকে এই বইটা পড়তে দিয়েছে—” ছোটাচ্চু সেই ইংরেজি বইটা আবার দেখাল।
টুনি বইটা দেখার কোনো উৎসাহ দেখালো না। ছোটাচ্চু অবশ্যি উৎসাহ নিয়ে বইটা খুলে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, “সরফরাজ কাফি বলেছে, আমাকে ম্যানেজমেন্টের সবকিছু শিখিয়ে দেবে। আমি কী ভাবছি জানিস?”
“কী ভাবছ?”
“আমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী তো বড় হচ্ছে, আমার আরো লোক দরকার। আমি নিজে বড় বড় ডিটেকটিভ কাজগুলো করবো। আর অফিসিয়াল কাজের জন্যে একজন লোক নিয়ে নিব। সরফরাজ যদি পার্ট-টাইম কাজ করতে রাজী থাকে—“
টুনি ছোটাচ্চুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “খবরদার ছোটাচ্চু! তুমি এই লোককে নেবে না।”
ঠিক তখন সবগুলো বাচ্চা ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকলো। ঢোকার সময় তারা শুধু টুনির কথাটা শুনেছে, আগে পিছে কিছুই জানে না, কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা হল না, প্রায় সবাই মিলে এক সাথে বলল, “না ছোটাচ্চু, তুমি এই লোককে নেবে না।”
শান্ত তারপর গলা নামিয়ে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “কোন লোক টুনি? এই লোক কী করেছে?”
ছোটাচ্চু ভুরু কুচকে সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরা কী চাস? এখানে কেন এসেছিস?”
একজন বলল, “বেশী চেচামেচি করছিলাম দেখে দাদী বের করে দিয়েছে। আমরা অবশ্যি এমনিতেই তোমার কাছে আসছিলাম।”
“কী জন্যে আসছিলি?”
“সবকিছু শোনার জন্যে। তোমার মাদারী মাদার বইটা দেখার জন্যে।”
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “মাদারী মাদার না—বইটা হচ্ছে মাদার অফ অল বুকস।”
“একই কথা।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “মোটেও একই কথা না।”
শান্ত টুনিকে আবার জিজ্ঞেস করল, “টুনি, তুই কোন লোককে নিতে না করছিস?”
“একজন মানুষ তার নাম সরফরাজ কাফি। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢুকতে চাচ্ছে।”
“কী নাম বললি?”
“সরফরাজ কাফি।”
“এটা আবার কী রকম নাম? এই নামের লোককে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না।” শান্ত ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, টুনি ঠিকই বলেছে, এই লোককে তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢোকানো যাবে না।”
ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোরা এখন বিদায় হবি? বিদায় হবি এখন থেকে? একেবারে পাগল ছাগলের হাতে পড়েছি।”
শান্ত বলল, “আয় যাই। আজকে যেখানেই যাচ্ছি সেখান থেকেই সবাই আমাদের বের করে দিচ্ছে। এই বাসায় মানুষজন কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।”
* * * * * *
দুইদিন পর রাত্রিবেলা কলিংবেল বাজল। শান্ত দরজা খুলে দেখল স্যুট টাই পরা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটির মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে তাই মাথার মাঝখানে সিঁথি করে চুলগুলো দুইভাগ করে টাক মাথাটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। মানুষটা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব আছেন?”
শান্তর কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে শাহরিয়ার মানুষটা কে, তখন তার মনে পড়ল ছোটাচ্চুর ভালো নাম হচ্ছে শাহরিয়ার। সে স্যুট টাই পরা মানুষটিকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ছোটাচ্চুকে ডেকে আনতে গেল।
ছোটাচ্চু বাইরের ঘরে এসে মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “আরে— সরফরাজ সাহেব! আপনি? আমার বাসায়?”
সরফরাজ নামের মানুষটা উঠে ছোটাচ্চুর হাত ধরে জোরে জোরে ঝাকাতে বলল, “আমি নিজেই চলে এসেছি। ভাবলাম শুভ কাজ দেরী করে কী লাভ? কাগজপত্র নিয়ে এসেছি, আপনার সিগনেচার নিয়ে যাই!”
ছোটাচ্চু বলল, “আপনার নিজের তো আসার দরকার ছিল না। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন!”
“না, না, আবার কাকে পাঠাব? নিজেই চলে এসেছি। যেহেতু এখন আপনার সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করতে হবে তাই ভাবলাম বাসাটা চিনে যাই!”
শান্ত ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হা করে সরফরাজের দিকে তাকিয়েছিল। ছোটাচ্চু বলল, “শান্ত তুই হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? যা, ভিতরে যা।”
শান্ত ভিতরে গেল, তারপর সবাইকে খবর দিল সরফরাজ কাফি নামের মানুষটা তাদের বাসায় চলে এসেছে, বাইরের ঘরে সোফায় বসে আছে। ছোটাচ্চুর কাছ থেকে কিসের জানি সিগনেচার নেবে।
তখন সবাই ছুটে গেল মানুষটাকে দেখার জন্যে, বাইরের ঘরের জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে টুম্পা ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা ভালো না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”
“দেখছ না স্যুট টাই পরে আছে। গরমের মাঝে যারা স্যুট টাই পরে থাকে, তারা মানুষ ভালো না।”
মুনিয়া বলল, “তাছাড়া মোছটাও ভালো না।
“মোছ ভালো না মানে কী?”
“দেখছ না কতো চিকন মোছ! চিকন মোছ মানেই সমস্যা।”
সবাই যখন ভীড় করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরফরাজ কাফিকে দেখছে তখন ঝুমু খালা হেঁটে যাচ্ছিল, সবাইকে জানালার কাছে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, “কী দেখ তোমরা?”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করতে একটা লোক এসেছে। লোকটা ভালো না খারাপ সেটা দেখছি।”
ঝুমু খালা বলল, “মানুষের চেহারা দেখে ভালো খারাপ বোঝা যায় না। ফিরেশতার মতোন চেহারা কিন্তু আসলে ইবলিশ এইরকম মানুষ আছে। আবার ইবলিশের মতোন চেহারা কিন্তু আসলে ফিরেশতা এইরকম মানুষও আছে। মানুষের ভালো খারাপ বোঝার জন্য অন্য নিয়ম আছে।”
“সেইটা কী?”
“পান পড়া। পানের উপর খাঁটি সরিষার তেল লাগায়া সেটা উপর তিনবার ফুঁক দিতে হয়। ফুঁক দেয়ার সময় বলতে হয় ভালায় ভালা, মন্দে কালা। তারপর সেই পানটা মানুষের কপালে ডলে দিতে হয়। মানুষটা ভালো হলে কিছু হবে না। মন্দ হলে কপাল থেকে কালা রং বের হবে। পানটা হবে কুচকুচা কালা—”
শান্ত বলল, “এই টেকনিক খুব ডেঞ্জারাস। মানুষটা মনে হয় তার কপালে পান পড়া ডলতে দিবে না।”
মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “সোজা নিয়ম নাই ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “আছে একটা সহজ উপায়।”
“কী?”
“চায়ের মাঝে চিনির বদলে লবণ দিয়া দিমু। যদি মানুষটা ভালো হয়। মগজের মাঝে দুই নম্বরি বুদ্ধি না থাকে তাহলে চা মুখে দিয়েই বলবে, হায়, হায়, চায়ের মাঝে দেখি লবণ! আর মানুষটা যদি দুই নম্বর হয়, যদি বদ মতলব থাকে তাহলে টু শব্দ না কইরা চা’টা খায়া ফেলব।”
“সত্যি?”
“সত্যি না তো মিথ্যা নাকী।”
“ঝুমু খালা, তাহলে তাড়াতাড়ি লবণ দেওয়া চা নিয়ে আস। প্লীজ।”
“ঠিক আছে।”
ঝুমু খালা তখন চা আনতে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই চা আর সাথে গরম গরম ভাজা ডালপুরি নিয়ে ঝুমু খালা বসার ঘরে হাজির হল। ছোটাচ্চুর সামনে চিনি দেওয়া চা, সরফরাজ কাফির সামনে লবণ দেয়া চা আর ‍দুইজনের মাঝখানে ডালপুরীর প্লেট রেখে ঝুমু খালা চলে এলো। তারপর ঝুমু খালাও অন্যদের সাথে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলো এখন কী হয়।
ছোটাচ্চু কাগজপত্রে সাইন করছিলো, ঝুমু খালার তৈরি স্পেশাল ডালপুরী দেখে কাগজপত্র সরিয়ে রেখে ডালপুরী খেতে শুরু করল। সরফরাজ কাফি অর্ধেকটা ডালপুরী ভেঙ্গে নিয়ে একটুখানি খেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। সবাই দেখলো কাপে চুমুক দিতেই তার মুখটা বিকৃত হয়ে উঠে, কাপটা মুখ থেকে সরিয়ে অবাক হয়ে সে কিছুক্ষণ কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটাচ্চু অবশ্য কিছুই লক্ষ্য করল না, গভীর মনোযোগ দিয়ে একটার পর একটা ডালপুরী খেয়ে যেতে লাগল। ডালপুরী ছোটাচ্চুর খুবই প্রিয়।
জানালার পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে সবাই তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে সরফরাজ কাফি এখন কী করে। প্রথমে মনে হলো বুঝি কাপটা নামিয়ে রাখবে। শেষ পর্যন্ত নামিয়ে রাখল না। একবার আড়চোখে ছোটাচ্চুকে দেখে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বিস্বাদ লবণাক্ত চা খেতে লাগল।
ঝুমু খালা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাতে কিল দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এই লোক দুই নম্বরীর ছাওয়াল চাইর নম্বর। মাথার মাঝে বদ মতলব। রগে রগে বদমাইসি। এর থেকে একশ হাত দূরে থাকন দরকার।”
সরফরাজ কাফি কাজ শেষ করে যখন চলে যাচ্ছে ঝুমু খালা তখন ট্রেতে করে খালি কাপ-প্লেট তুলে আনতে আনতে জিজ্ঞেস করল, “চা নাস্তা ঠিক ছিলো আংকেল।”
সরফরাজ কাফি এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালো ছিল। খুব ভালো ছিল। থ্যাংকু।”
ঝুমু খালা বলল, “পরের বার যখন আসবেন তখন আরো ভালো চা নাস্তা দিব।”
সরফরাজ কাফি কোনো কথা না বলে চোখ ছোট ছোট করে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইল।

ছোটাচ্চু তার নিজের ঘরে পৌঁছানোর আগেই সবগুলো বাচ্চা তার ঘরে হামলা করল।
একজন বলল, “ছোটাচ্চু কাজটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “কোন কাজটা?”
“এই যে একজন দুই নম্বুরী মানুষকে তোমার সাথে নিচ্ছ।”
ছোটাচ্চু রেগে বলল, “কী রকম বেয়াদপের মত কথা বলছিস, একজন সম্মানী মানুষ নিজ থেকে আমাকে সাহায্য করার কথা বলছে আর তোরা ঘ্যান ঘ্যান করছিস?”
“তুমি হচ্ছ আমাদের ছোটাচ্চু—তোমাকে আমরা কিছু বলতে পারব না?”
“পারবি না কেন? একশবার পারবি। কিন্তু বড়দের ব্যাপারে তোরা নাক গলাচ্ছিস কেন? তোরা এসবের কিছু বুঝিস না জানিস?”
প্রমি মুখ শক্ত করে বলল, “একটা জিনিস জানি আর বুঝি।”
“কী জিনিস?”
মুনিয়া বলল, “এই মানুষটা দুই নম্বুরীর ছাওয়াল চার নম্বুরী।”
ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললি? কী বললি তুই?”
ঝুমু খালার বাক্যটা দ্বিতীয় বার বলা ঠিক হবে না ভেবে মুনিয়া চুপ করে গেল।
টুম্পা বলল, “আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি মানুষটা খারাপ।”
“কীভাবে পরীক্ষা করেছিস?”
ঝুমু খালার লবণ-চা পরীক্ষার কথা বললে ঝুমু খালা বিপদে পড়ে যেতে পারে বলে কেউ পরীক্ষার পদ্ধতিটা নিয়ে কথা বলল না। মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
ছোটাচ্চু বলল, “তোরা এখন বিদায় হ। আমার এই কাগজগুলো পড়তে হবে।”
সরফরাজ কাফি ছোটাচ্চুকে পড়ার জন্যে বান্ডিল বান্ডিল কাগজ দিয়ে গেছে, ছোটাচ্চু কাগজগুলো সবাইকে দেখাল। তারপর আঙুল দিয়ে দরজাটা দেখিয়ে দিল, ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট—সবাই যেন বের হয়ে যায়। বাচ্চাগুলো তখন একজন একজন করে বের হয়ে গেল। টুনি বের হলো সবার শেষে, কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না।
আধা ঘন্টা পর টুনি ছোটাচ্চুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল ছোটাচ্চু কাগজের বান্ডিলের উপর মাথা রেখে মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে। ছোট ছোট অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা বান্ডিল বান্ডিল কাগজ পড়া ছোটাচ্চুর পক্ষে পড়া সম্ভব না। ঠিক কী কারণ জানা নেই টুনির ছোটাচ্চুর জন্যে একটু মায়া হল।
* * * * * *
পরদিন সকালে ছোটাচ্চু তার দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে গিয়ে দেখে রঞ্জনা কেমন যেন হতচকিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ছোটাচ্চু বলল, “কী খবর রঞ্জনা?”
রঞ্জনা বলল, “না মানে ইয়ে—” কিন্তু বাক্যটা শেষ করল না, কেমন যেন ভ্যাবেচেকার ভঙ্গি করে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে তার ঘরে ঢুকে থমকে দাড়াল। অফিসে তার বড় ডেস্কটার পিছনে তার গদি আঁটা চেয়ারে সরফরাজ কাফি বেশ আয়েশ করে বসে আছে। সামনে একটা ফাইল সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ছোটাচ্চু যতটুকু বিরক্ত হল অবাক হল তার থেকে বেশি। এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাড়াল, ধরে নিল সরফরাজ কাফি তাকে দেখে চেয়ারটা ছেড়ে দেবে।
সরফরাজ কাফি চেয়ার ছেড়ে ওঠার কোনো নিশানা দেখালো না, হাসি হাসি মুখে বলল, “এই যে শাহরিয়ার সাহেব। গুড মর্নিং!”
ছোটাচ্চু গুড মর্নিংয়ের উত্তর না দিয়ে বলল, “মানে—আপনি আমার চেয়ারে?”
সরফরাজ কাফি এমনভাবে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল যে দেখে মনে হলো সে ছোটাচ্চুর কথা বুঝতে পারছে না। একটু অবাক হয়ে বলল, “আ-আপনার চেয়ার?”
“হ্যাঁ। এইটা আমার অফিস। আমার ডেস্ক। আমার চেয়ার।”
সরফরাজ কাফির হাসি আরো বিস্তৃত হলো, ছোটাচ্চুকে সামনে বসার ইঙ্গিত করে বলল, “কিন্তু আমরা যে কাল রাতে কন্ট্রাক্ট করলাম? আপনি ফিল্ড লেভেলে কাজ করবেন, আমি ম্যানেজমেন্ট দেখব। আপনি যেহেতু ফিল্ডে কাজ করবেন, কোনো অফিসের দরকার নেই, আমি এই অফিসে বসব।”
ছোটাচ্চুর মুখটা হা হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “ক-কনট্রাক্টে তাই লেখা ছিল?”
“হ্যাঁ। আপনাকে একটা কপি দিয়ে এসেছি, পড়েননি?”
ছোটাচ্চু তার পায়ে জোর পাচ্ছিল না, কোনোভাবে একটা চেয়ারে বসে বিড় বিড় করে বলল, “কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”
সরফরাজ কাফি জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, গোলমাল হবে কেন? আমি আর আপনি মিলেই তো সবকিছু ঠিক করেছি। এইযে আমি ফাইল নিয়ে বসেছি। ফাইলে লেখা দশটার সময় আপনার একটা এপয়ন্টমেন্ট আছে পুরান ঢাকায়। এখন বাজে সাড়ে নয়টা, এক্ষুনি বের হয়ে যান তা না হলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবেন না।” সরফরাজ কাফি তারপর গলা উচিয়ে ডাকল, “রঞ্জনা, শাহরিয়ার সাহেবকে একটা স্লিপ দাও। ফিরে আসার পর খরচের ভাউচার নিতে ভুলে যেও না।”
সরফরাজ কাফি আবার হাসি হাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর গলা লামিয়ে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব, আপনাকে আরো একটা জিনিস বলি। এতোদিন আপনি এই এজেন্সিটাকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালিয়েছেন, এখন যেহেতু আমি দায়িত্ব নিয়েছি এখন এটাকে যেভাবে খুশি সেভাবে চালানো যাবে না। একটা নিয়মের ভিতর আসতে হবে, শৃঙ্খলার ভিতর আসতে হবে। যেমন ধরেন, অফিসের টাইম হচ্ছে নয়টা, আপনি এসেছেন সাড়ে নয়টায়—ভবিষ্যতে এটা হতে পারবে না। তারপর ধরেন আপনার পোশাক—একটা টি-শার্ট পরে চলে এসেছেন, এটাো ঠিক হয় নাই। কমপক্ষে ফুল হাতা শার্ট আর টাই। এখন টাইয়ের ফ্যাশন হচ্ছে চওড়া, চিকন একটা টাই পরে চলে আসবেন না যেন—”

এরকম সময় ছোটাচ্চু বিকট আঁ আঁ শব্দ করে সরফরাজ কাফির উপর ঝাপিয়ে পড়ল। প্রথম ঘুষিটা লাগাতে পারল না, তবে দ্বিতীয়টা ঠিক ঠিক লাগলো এবং সরফরাজ কাফি চেয়ার সহ পিছন দিকে পড়ে গেল। ছোটাচ্চু লাফ দিয়ে সরফরাজ কাফির বুকের উপর বসে তার টাইটা টেনে বলল, “তবে রে দুই নম্বুরির ছাওয়াল চাইর নম্বুরি—”
সরফরাজ কাফি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, “হেল্প! হেল্প!!”
চিৎকার শুনে রঞ্জনা এসে পিছন থেকে ছোটাচ্চুকে ধরে কোনোমতে টেনে সরিয়ে আনল।

রাত্রি বেলা বাসায় খুবই উত্তেজনায়। অনেকদিন পর বাসায় এরকম উত্তেজনা হয়েছে। ছোটাচ্চু একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে আছে। তার মোটামুটি বিধ্বস্ত চেহারা। বড় চাচা ঘরে পায়চারি করছেন, একটু আগে অনেক কষ্ট করে বড় চাচা ছোটাচ্চুকে হাজত থেকে ছুটিয়ে এনেছেন। ছোটাচ্চুর হাতে মার খেয়ে সরফরাজ কাফি তার কোম্পানিকে ফোন করেছে, কোম্পানি ফোন করেছে পুলিশকে। পুলিশ এসে ছোটাচ্চুকে ধরে হাজতে নিয়ে গেছে। বড় চাচার সাথে পুলিশের বড় অফিসারের পরিচয় আছে তা না হলে কী হতো কে জনে।
দাদী (কিংবা নানী) অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে মাথা নাড়তে নাড়তে সতেরোবারের মত বললেন, “আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার ছেলে মারপিট করে জেল হাজতে গেছে। আমার ছেলে? যে ছেলেকে আমি পেটে ধরেছি, সে মানুষের সাথে মারপিট করে জেল হাজতে যায়?”
দাদী যেটাই বলে ঝুমু খালা সবসময়েই সেটা বলে, এই প্রথমবার তার ব্যতিক্রম দেখা গেল। সে গলা উচিয়ে বলল, “এইটা আপনি কী বলেন খালা? জেল হাজত কেন—দরকার হলে আপনার ছেলে কালাপানিতে যাবে—কিন্তু চোর ছ্যাচর বান্দরের বাচ্চাদের পিটায়া সাইজ করবে না?”
ঝুমু খালা তারপর ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইজান, আপনি এই বদমাইসের বাচ্চাকে আচ্ছা মতন দুইটা দিছেন তো? ঘুষি মাইরা নাকের হাড্ডিটা ভাইঙ্গা দিছেন তো?”
বড় চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, “ঝুমু। তুমি থামবে? কী সব কথা বলছ? ছিঃ।”
ঝুমু খালা থামার কোনো লক্ষণ দেখালো না, বলল, “আপনি কী বলেন বড় ভাইজান, আমি যে খালি ঘরে বইসা তড়পাচ্ছি এইটা ওই বান্দরের বাচ্চার সাত পুরুষের ভাগ্য! ছোট ভাইজানরে সোজা সরল মানুষ পাইয়া হাজতে দেয়—আমার সাথে তেড়ি বেড়ি করতে আসতো আমি গিয়া খাবলা দিয়া চোখ দুইটা তুইলা আনতাম।”
বড় চাচা হাল ছেড়ে দিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন কী অবস্থা?”
ছোটাচ্চু পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বড় চাচার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বের করে দিয়েছে।”
ঘরের সবাই চমকে উঠল! বড় চাচা বললেন, “কী বলছিস? তোকে তোর কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছে?”
ছোটাচ্চু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “এটা এখন আর আমার কোম্পানী না। ঐ পাজী মানুষটা আমাকে দিয়ে কীসব কাগজ সাইন করিয়ে নিয়েছিল, আমি বুঝি নাই—এখন অফিসিয়ালি আমি ডিটেকটিভ এজেন্সির কেউ না। সবকিছুর মালিক সরফরাজ কাফির কোম্পানি।”
বড় চাচা হুংকার দিয়ে বললেন, “এটা কী মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকী যে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলবে?”
বড় চাচা খুবই শান্ত মানুষ কেউ তাকে কোনোদিন গলা উচিয়ে কথা বলতে শুনে নাই। তাই হঠাৎ করে বড় চাচা যখন হুংকার দিলেন, তখন সবাই অবাক হয়ে বড় চাচার দিকে তাকিয়ে রইল। বড় চাচা কী বলছেন কেউ শুনছে না কীভাবে বলছেন সেটাই সবাই দেখছে।
বড় চাচা হাত পা নেড়ে বললেন, “আমার পরিচিত সুপ্রীমকোর্টর ল’য়ার আছে, আমি মামলা করে দেব—”
ছোটাচ্চু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না ভাইজান। আমার মামলা করার ইচ্ছা নাই। যা হবার হয়েছে—আমি এর মাঝে আর নাই।”
তারপর কাউকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে ছোটাচ্চু নিজের ঘরের দিকে হেঁটে যেতে থাকল। বড় মানুষ কেউ তার সাথে গেল না কিন্তু বাচ্চারা সবাই দলবেধে তার পিছু পিছু গেলো।
ছোট চাচ্চু তার ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই তাকে ঘিরে দাড়াল। টুনি নরম গলায় ডাকল, “ছোটাচ্চু—”
ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু বলবি?”
“তোমার কী মন খারাপ ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “এখন মনটা কাজ করছে না, থেমে আছে। তাই বুঝতে পারছি না। যখন মনটা কাজ করতে শুরু করবে তখন বুঝতে পারব।”
“তুমি মন খারাপ করো না ছোটাচ্চু।”
তখন সবাই এক সাথে বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু মন খারাপ করো না। প্লীজ ছোটাচ্চু—প্লীজ। তুমি মন খারাপ করলে আমাদেরও মন খারাপ হবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে মন খারাপ করব না।” একটু থেমে বলল, “আসলে তোরা ঠিকই অনুমান করেছিলি যে সরফরাজ মানুষটা বদ।”
একজন বলল, “বদের লাঠি।”
আরেকজন বলল, “পাজীর পা ঝাড়া।”
আরেকজন বলল, “খাটাসের বাচ্চা খাটাস।”
তখন সবাই মিলে সরফরাজ কাফিকে গালিগালাজ শুরু করল। সেকী গালিগালাজ, মনে হলো গালিগালাজের তাপে ঘরে বুঝি আগুন ধরে যাবে।
গালাগাল একটু কমে আসার পর টুনি আবার ছোটাচ্চুকে ডাকল, “ছোটাচ্চু।”
“বল।”
“তোমাকে একটা কথা বলি?”
“বল।”
“তোমাকে যদি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী টা ফিরিয়েও দেয় তুমি সেটা নিয়ো না।”
ছোটাচ্চু একটু অবাক হয়ে বলল, “নিব না?”
“না।”
“কেন?”
“বড় অফিস নেওয়ার পর তুমি অন্য রকম হয়ে গেছো। তোমার সাথে আমাদের আর দেখা হয় না। মনে আছে আগে কতো মজা হতো? সবসময় তুমি আমাদের সাথে থাকতে!”
অন্য সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি আমাদের সাথে থাকতে আর আমাদের কতো মজা হতো।”
একজন বলল, “মনে আছে একবার একটা ছাগলকে রং করে দিয়েছিলে?”
আরেকজন বলল, “তারপর আমরা নাটক করলাম?”
আরেকজন বলল, “আর ঐ যে একবার রাজাকার টাইপের নানা যখন এসেছিল তখন রাত্রে ভূতের ভয় দেখানো হল।”
আরেকজন বলল, “তারপর একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করলাম? ভৌতিক সংখ্যা?”
আরেকজন বলল, “শান্ত ভাইয়া যখন স্কুলে ঝামেলায় পড়ল তুমি গার্জিয়ান সেজে গিয়ে শান্ত ভাইয়াকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে।”
আরেকজন বলল, “স্কুলের স্পোর্টসের দিন তুমি আমাকে ডাইনী বুড়ী সাজিয়ে দিলে মনে আছে?”
আরেকজন বলল, “আমার সায়েন্স ফেয়ারের প্রজেক্টের জন্যে তুমি জোঁক ধরে আনলে মনে আছে?”
আরেকজন বলল, “সায়েন্স টিচারকে সেই জোঁক কামড়ে ধরল, আর সায়েন্স টিচার চিৎকার করে সবকিছু উল্টা পাল্টা করে ফেলল?”
মুনিয়া তখন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এখন তুমি কিছু করো না।”
ছোটাচ্চু সবার দিকে তাকালো কিছু বলল না।
টুনি বলল, “তুমি আবার আগের মত হয়ে যাও।”
“সেটা কীরকম?”
“ওইতো—”
“ওইতো মানে কী?”
“আগের মতোন—পুরোপুরি অপদার্থ।”
ছোটাচ্চু হেসে ফেলল, আর তাকে হাসতে দেখে অন্য সবাই হি হি করে হাসতে থাকলো। হাসি আর থামতেই চায় না।

ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে শান্ত নিচু গলায় বলল, “সরফরাজ কাফিকে সাইজ করতে হবে।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে সাইজ করবে ভাইয়া?’
“এখন বলব না।”
টুনি ভুরু কুচকে বলল, “শান্ত ভাইয়া তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তোমার মাথা গরম, কী না কী করে ফেলবে আরো বড় ঝামেলা হবে।”
শান্ত বলল, “হলে হবে। শুধু সরফরাজ কাফির টেলিফোন নম্বরটা দরকার।”
টুনি বলল, “সর্বনাশ! টেলিফোন করলে আরো বিপদে পড়বে—”
“আমি টেলিফোন করব না।”
“তাহলে?”
“এখন বলব না।” বলে শান্ত আবার ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকে গেল। ছোটাচ্চু বাথরুমে গোসল কতে ‍ঢুকেছে, টেবিলে তার মোবাইল ফোন রেখে গেছে। সেখান থেকে খুব সহজেই সরফরাজ কাফির মোবাইল নম্বর পাওয়া গেল।
একটু পরেই শান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল, যাবার আগে সে ঝুমু খালার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা ধার নিয়ে গেল। এই রাত্রি বেলা শান্ত কোথায় গেছে, কী করবে সেগুলো নিয়ে টুনি খুবই দুশ্চিন্তার মাঝে ছিল কিন্তু আধাঘণ্টার মাঝেই শান্ত ফিরে এলো। কোথায় গিয়ে কী করেছে কিছুই সে বলল না।

পরদিন স্কুলে যাবার সময় বাচ্চারা দেখলো বড় রাস্তার মোড়ে নূতন একটা বিল্ডিংয়ের ধবধবে সাদা দেওয়ালে আলকাতরা দিয়ে লেখা:
“পাঁচশ টাকার নোট একশ টাকায়”

তার নিচে একটা টেলিফোন নম্বর।
লেখাটির সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত যখন সবার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল তখন সবাই বুঝে গেল যে এটা শান্তর কাজ, এবং নিচের নম্বরটি সরফরাজ কাফির।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “এটা তুমি লিখেছ?”
“নিজে লিখি নাই। একজনকে পঞ্চাশ টাকায় সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছি। ব্যাটার হাতের লেখা ভালো না।”

শান্তর এই প্রজেক্ট কাজে লেগেছে কীনা বোঝা গেল না।
ছোটাচ্চু দুইদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটাল। তৃতীয় দিন দরজা খুলে বের হয়ে এলো। বাচ্চার আশেপাশেই ছিল, তারা তাকে ঘিরে দাড়াল। মুনিয়া ছোটাচ্চুর হাত ধরে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি শেভ করো নাই, বিন্দি বিন্দি দাড়ি বের হয়েছে।”
ছোটাচ্চুকে অবশ্য তার বিন্দি বিন্দি দাড়ি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতে দেখা গেল না, ভুরু কুচকে বলল, “এই মাত্র আমাকে ডিবি পুলিশ ফোন করেছে।”
বাচ্চারা ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“জানতে চাইছে আমি সরফরাজ কাফিকে কতোদিন থেকে চিনি, ঐ ব্যাটা জাল নোটের ব্যবসা করে এরকম কিছু আমি জানি কি না।”
শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”
ছোটাচ্চু তার গালের বিন্দি বিন্দি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, “পুলিশ ব্যাটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রিমান্ডে নিবে কীনা বুঝতে পারছে না।”
এবারে শান্তর সাথে আরো অনেকে হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস!”
টুনি জিজ্ঞেস করলো, “তুমি পুলিশকে কী বলেছ?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি বলেছি ব্যাটা জাল নোটের ব্যবসা করে কীনা জানি না তবে মানুষটা পুরাপুরি দুই নম্বুরী তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমাকে ঠকিয়ে আমার এজেন্সি লিখে নিয়েছে।”
এবারে সবাই হুংকার দিয়ে বলল, “ধ্বংস হোক! ধ্বংস হোক!”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ব্যাটা মনে হয় বিপদে পড়েছে। আমাকে একটু পরে পরে ফোন করছে। আমি ফোন ধরছি না—”
সবাই বলল, “হ্যাঁ, ধরবে না ফোন। কক্ষনো ধরবে না।”
ছোটাচ্চু তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বাথরুমে ঢুকে গেল, মনে হয় বিন্দি বিন্দি দাড়ি শেভ করে ফেলবে।
ঝুমু খালার ধার শোধ করার জন্য শান্ত যখন সবার কাছ থেকে চাঁদা চাইল সবাই তখন উদারভাবে শান্তকে চাঁদা দিল। কিছুক্ষণেই পঞ্চাশ টাকা থেকে বেশী টাকা উঠে গেল, শান্ত ঝুমু খালাকে তার পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাকীটা সার্ভিস চার্জ হিসেবে নিজের পকেটে রেখে দিল।
অন্য যেকোনো সময় এরকম কিছু হলে বাচ্চারা চেচামেটি হই চই করে তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলতো—এবারে কেউ সেটা নিয়ে কিছু করল না। এরকম একটা সফল প্রজেক্টের জন্যে শান্ত কিছু সার্ভিস চার্জ নিতেই পারে।
সন্ধ্যেবেলা বাসার ছাদে ছোটাচ্চু তার মাদার অফ অল বুকসটাকে পুড়িয়ে কেতলিতে পানি গরম করে চা বানালো। সবাই সেই চায়ের ভাগ পেলো—মুনিয়াকে পর্যন্ত বেশি দুধ চিনি দিয়ে আধা কাপ চা দেওয়া হল।

মনে হচ্ছে ছোটাচ্চু আবার আগের ছোটাচ্চু হয়ে যাচ্ছে। কাজ নাই, কর্ম নাই এবং পুরোপুরি অপদার্থ।

লুডো টুর্নামেন্ট

লুডো টুর্নামেন্ট


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুনিয়া একটা লুডোর বোর্ড, তার ছক্কা আর গুটির বাক্স নিয়ে গিয়েছে টুম্পার কাছে। টুম্পা গভীর মনোযোগ দিয়ে কাগজ কেটে কেটে একটা প্রজাপতি বানাচ্ছিল। মুনিয়া তাকে বলল, “টুম্পা আপু, আমার সাথে লুডো খেলবে?”
টুম্পা বলল, “উহুঁ। এখন খেলতে পারব না। দেখছিস না এই প্রজাপতিটা তৈরি করছি, তারপর এইটা রং করতে হবে তারপর রং শুকাতে হবে। অনেক কাজ।”
মুনিয়া তখন গেল প্রমির কাছে, গিয়ে বলল, “প্রমি আপু তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”
প্রমি বলল, “কেমন করে খেলি, বল। হোমওয়ার্ক এখনো শেষ হয় নাই যে।”
মুনিয়া তখন গেল শাহানার কাছে, শাহানাও বলল তার সময় নেই। মুনিয়া শান্তর কাছে যাবে কী না ঠিক করতে পারছিল না। কিন্তু যেহেতু দোতালার সিড়িতে তার সাথে দেখা হয়েই গেল তাই তাকে জিজ্ঞেস করল, “শান্ত ভাইয়া তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”
শান্ত চিৎকার করে হাত পা নেড়ে মাথা ঝাকিয়ে বলল, “কী বললি তুই? লুডো? তোর সাথে? আমার কী মাথা খারাপ হয়েছে যে তোর মতো একটা গেন্দা বাচ্চার সাথে বসে বসে এখন আমি লুডো খেলব? আমার কী কাজের অভাব পড়েছে? যা যা— ভাগ এখান থেকে!”
শান্তর কথা শুনে মুনিয়া কিছু মনে করল না। শান্ত সব সময় এইভাবেই কথা বলে। ভালো ভাবে কথা বললেই বরং মুনিয়া অবাক হতো। মুনিয়া তখন গেল টুনির কাছে। টুনি বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিল, মুনিয়াকে দেখে বলল, “কী খবর মুনিয়া?”
মুনিয়া বলল, “টুনি আপু, তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”
টুনি মাথা চুলকে বলল, “লুডো? তোর সাথে?”
“হ্যাঁ।”
টুনি বলল, “লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই, পুরোটা হচ্ছে লটারী। অন্য কিছু খেলিস না কেন?”
“আমি অন্য কোনো খেলা পারি না।”
“আয় তোকে দাবা খেলা শিখিয়ে দেই। দাবা হচ্ছে বুদ্ধির খেলা।”
মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “উহুঁ। আমি বুদ্ধির খেলা খেলতে চাই না। আমি লুডো খেলতে চাই।”
“কেন তুই বুদ্ধির খেলা শিখতে চাস না?”
মুনিয়া বলল, “আমার বুদ্ধি ভালো লাগে না।”
টুনি একটু অবাক হয়ে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এই বাসায় এখন সবচেয়ে ছোট হচ্ছে মুনিয়া, সে এখনই বুঝি গেছে বুদ্ধি বিষয়টা ভালো না!
টুনি বলল, “ঠিক আছে তোর সাথে আমি লুডো খেলব কিন্তু একটু সময় দে, বইটার খুব ইন্টারেস্টিং একটা জায়গায় এসেছি তো এইটা শেষ করে আসি।”
মুনিয়ার অপেক্ষা করার সময় নাই। সে তখন গেল ঝুমু খালার কাছে, গিয়ে বলল, “ঝুমু খালা তুমি আমার সাথে লুডো খেলবে?”
ঝুমু খালা বলল, “অবশ্যই খেলব। লুডো আমার সবচেয়ে পছন্দের খেলা। আমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা লুডো খেলতে পারি। তবে সাপ লুডো একটু ভয় লাগে। সাপ দেখলেই আমার শরীর কী রকম জানি ইজিবিজি করে।”
মুনিয়া বলল, “এইগুলো তো সত্যি সাপ না।”
“সত্যি হোক মিথ্যা হোক কিছু আসে যায় না। সাপ দেখলেই শরীর ইজিবিজি করে।”
“তোমার কোনো ভয় নাই ঝুমু ক্ষালা, আমি সাপ লুডো খেলব না।“
ঝুমু খালা খুশী হয়ে বলল, “চমেৎকার!”
মুনিয়া বলল, “তাহলে বোর্ডটা এখানে পাতব? গুটি বসাব?”
ঝুমু খালা বলল, “মুনিয়া সোনা আমাকে দুইটা মিনিটি সময় দাও। ডালটা বাগাড় দিয়ে ফেলি, ভাতটা নামিয়ে মাছগুলো ভেজে ফেলি—”
মুনিয়া হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল, সে জানে এতোগুলো কাজ কোনোভাবেই দুই মিনিটে শেষ হবে না। তাই তখন সে দাদীর (কিংবা নানীর) কাছে গেল নালিশ করতে। দাদী বসার ঘরে সোফায় বসে আছেন, তার পাশে একটা ষোল সতেরো বছরের ছেলে বসে আছে। ছেলেটা দেখতে অনেক স্মার্ট আর চেহারা খুব সুন্দর। একটা কালো টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরে আছে।
মুনিয়াকে দেখে দাদী জিজ্ঞেস করলেন, “মুনিয়া তোর মুখটা এতো ভার কেন? কী হয়েছে?”
“দাদী, কেউ আমার সাথে খেলতে চায় না।”
“কেউ তোর সাথে খেলতে চায় না? এতো বড় সাহস? সবগুলোকে ডেকে আন, খুন করে ফেলব সবগুলোকে আজকে।”
“সত্যি ডেকে আনব?”
“হ্যাঁ সত্যি।”
“সত্যি খুন করে ফেলবে?”
“সত্যি না তো মিথ্যা নাকী? সবাইকে বল আমার একজন নাতি এসেছে তার সাথে পরিচয়ও করিয়ে দেব।”
মুনিয়া তখন সবাইকে ডেকে আনল, তাদের সবাইকে খুন করে ফেলা হবে বলার পরও কাউকে সেরকম দুশ্চিন্তিত দেখা গেল না। দাদীর এই নতুন নাতিটি কে এবং কোথা থেকে এসেছে সেটা জানার জন্যে সবার ভেতরেই একটু কৌতুহল।
দাদী তার নতুন নাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, বলল, “এই যে এ হচ্ছে আমার ছোটবেলার বান্ধবী জোবেদার নাতি। জোবেদার নাতি মানে আমার নাতি।”
সবাই দাদীর নাতিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে মনে মনে এ প্লাস দিয়ে দিল। ছেলেটা স্মার্ট আর সুন্দর। কাপড় জামাও যথেষ্ট ভালো। এই বয়সের মেয়েরা খুব সুইট হয় কিন্তু ছেলেরা কেমন যেন ভ্যাবলা ধরণের হ্যে যায়। কিন্তু এই ছেলেটা মোটেও ভ্যাবলা ধরণের নয়।
দাদী বললেন, “এর নাম মিশু।” তারপর অন্যদের দেখিয়ে বললেন, “মিশু এরা আমার নাতি নাত্নি। এদের থেকে খুব সাবধান, একজন থেকে আরেকজন আরো বেশী ত্যাঁদড়।”
শান্ত আপত্তি করল, বলল, “দাদী কথাটা ঠিক বললে না তুমি। আমরা মোটেও ত্যাঁদড় না।”
দাদী বললেন, “ঠিক আছে। সেইটা নিয়ে আলোচনা না করলাম।” তারপর মিশুকে দেখিয়ে বললেন, “মিশু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে বলে এসেছে। অন্য কোথায় থাকতে চাইছিল, আমি বলেছি আমি থাকতে অন্য কোথায় কেন থাকবে? তাই এখন এই বাসায় কয়দিন থাকবে।”
প্রমি বলল, “মিশু ভাই তুমি কোন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে?”
মিশু উত্তর দেবার আগেই দাদী বললেন, “মিশু যে কয়টা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে তার প্রত্যেকটাতে চান্স পেয়েছে! সবগুলোতে একেবারে প্রথম দিকে আছে, তার মানে হচ্ছে বাংলাদেশের যে কোনো ইউনিভার্সিটির যে কোনো সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারবে। তাই না মিশু?”
মিশু লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, বলল, “আপনি এমন ভাবে বলছেন যেন এইটা সাংঘাতিক কিছু। এটা এমন কিছু না আমার থেকে আরো কতো ভালো ছাত্রছাত্রী আছে।”
দাদী বলল, “থাকলে থাকুক, তাদেরকে তো আর আমি চিনি না! আমি চিনি তোমাকে।”
দাদী বলল, “দেখবেন আপনার নাতি নাত্নিরা আরো ভালো হবে!”
দাদী চোখ কপালে তুলে বলল, “আমার নাতি নাত্নি? এরা কোনোদিন বই খুলে দেখে মনে করছ? বইয়ের সাথে এদের কারো কোনো সম্পর্ক নাই।”
টুনি আপত্তি করল, “কী বলছ দাদী? শাহানা আপু হচ্ছে জিনিয়াস। সায়েন্স ফেয়ারে দুইবার গোল্ড মেডেল পেয়েছে।”
“হ্যাঁ, শাহানাটাই কেবল একটু লেখাপড়া করে। যাই হোক তোরা মিশুকে নিয়ে যা— কোথায় থাকবে কী সমাচার ঠিক করে দে।”
মুনিয়া তখন দাদীকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল, “দাদী, তুমি বলেছিলে এদের খুন করবে। এরা কেউ আমার সাথে লুডো খেলতে চায় না—”
দাদীর মনে পড়ল, মাথা নেড়ে বললেন, “ও হ্যাঁ। তোরা কেউ মুনিয়ার সাথে খেলতে চাস না কেন? বেচারী একটা লুডোর বোর্ড নিয়ে কতোক্ষন থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
সবাই একসাথে একটু যন্ত্রণার শব্দ করল। প্রমি বলল, “দাদী লুডো খেলার মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই, এইটা খেলার ইচ্ছা করে না।”
টুনি বলল, “আমি বলছিলাম মুনিয়াকে দাবা খেলাটা শিখিয়ে দেই—”
হঠাৎ করে মিশু বলল, “আমি একটা কথা বলি?”
সবাই থেমে গেল, মিশুর দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মিশু বলল, “তোমরা সবাই বলছ লুডো খেলার মাখে কোনো বুদ্ধি নাই। কিন্তু আমার মনে হয় আছে।”
শান্ত বলল, “আছে? যার ছক্কা বেশী পড়ে সে জিতে— এর মাঝে বুদ্ধিটা কোনখানে?”
মিশু হাসি হাসি মুখ করে বলল, “হ্যাঁ আছে। এর মাঝেও বুদ্ধি আছে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা একটা লুডো টুর্নামেন্ট করো আমিও সেখানে খেলি।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি খেলে চ্যাম্পিয়ন হবে?”
মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “যদি চাই তাহলে হতে পারি।”
শান্ত চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তার মানে তুমি আমাদের সবাইকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছ?”
মিশু বলল, “আমি ঠিক চ্যালেঞ্জ শব্দটা ব্যবহার করতে চাই না কিন্তু বলা যায় তোমরা কোনোভাবে মনে হয় আমাকে হারাতে পারবে না।”
“সত্যি?”
মিশু মাথা নাড়ল, প্রমি বলল, “দেখা যাক।”
শান্ত বলল, “ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া। ছোটাচ্চুকে বলি স্পন্সর করতে। টুর্নামেন্টের নাম হবে ‘ছোটাচ্চু লুডো টুর্নামেন্ট’। এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা। আমি হব ইভেন্ট ম্যানেজার আর রেফারী। দাদী হবে চীফ এডভাইজার। ফাটাফাটি ইভেন্ট!”
মুনিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমার সাথে কে খেলবে?”
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। সবাই তখন লুডো টুর্নামেন্ট নিয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে শুরু করেছে।

শান্তর ঘরে মিশুর থাকার জায়গা করে দেয়া হল। মিশু তার ব্যাক প্যাক থেকে বইপত্র বের করে বিছানায় রাখে। শান্ত বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল, সাইকোলজির একটা বই ধরতেই শান্ত বইটা তার হাত থেকে নিয়ে নিল, বলল, “এই বইটা তুমি দেখতে পারবে না।”
“কেন?”
“এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক দেখাই। এটা আমার ম্যাজিক বই।”
“ম্যাজিক বই?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল,“কী রকম ম্যাজিক বই?”
“এই দেখ—” বলে মিশু বইটা খুলে পৃষ্ঠা উল্টে দেখাল। শান্ত কোনো ম্যাজিক দেখল না। খুবই সাধারণ একটা বই. ভুরু কুচকে বলল, “কোথায় ম্যাজিক?”
“এই দেখ।” বলে শান্ত বইটার উপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন দিল। তারপর বইটা খুলতেই দেখে প্রত্যেক পৃষ্ঠায় একটা ক্রস আঁকা।
শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কী আশ্চর্য!”
মিশু জিজ্ঞেস করল, “কোনটা তোমার কাছে আশ্চর্য লেগেছে?”
“এক্ষুনি বইটাতে কিছু ছিল না এখন প্রতি পৃষ্ঠায় ক্রস।”
মিশু বলল, “ক্রশ? কোথায় ক্রস?” বলে সে বইটা আবার খুলে দেখায়, প্রতিটি পৃষ্ঠা আগের মতো, কোনো ক্রস নেই? শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, বলল, “আমাকে শেখাবে কেমন করে এই ম্যাজিকটা দেখাও।”
মিশু বলল, “সবাইকে সবকিছু শেখানো যায় না। কোনো কিছু ভালো করে শিখতে হলে তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়।”
হাতমুখ ধুয়ে মিশুকে নিয়ে শান্ত নিচে নাস্তা খেতে এলো। ঝুমু খালা টেবিলে গরম গরম ডালপুরী আর চা দিয়েছে। সবাই ঝুমু খালার বিখ্যাত ডালপুরীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। চা অবশ্যি সবার কপালে জুটে না— এই বাসায় একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত চা খাবার পারমিশন পাওয়া যায় না। ঝুমু খালার মন ভালো থাকলে মাঝে মাঝে এক দুইজনকে বেশী করে দুধ চিনি দিয়ে আধা কাপ চা তৈরি করে দেয়।
আজকে ঝুমু খালার মন নিশ্চয়ই ভালো ছিল তাই টুম্পাকে আধ কাপ চা দিয়েছে। টুম্পা খুবই গম্ভীর ভঙ্গীতে সেই চা খাচ্ছে তখন মিশু টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার চায়ে একটু ম্যাজিক করে দিই?”
টুম্পা অবাক হয়ে বলল, “ম্যাজিক?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত তখন চোখ বড় বড় করে হাত পা নেড়ে নেড়ে বলল, “ও, তোরা কেউ জানিস না, মিশু ভাই আস্ত ম্যাজিসিয়ান। একেবারে জুয়েল আইচ!”
সবাই মিশুর দিকে ঘুরে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
মিশু কিছু বলল না, শান্ত জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি মানে সত্যি! ডাবল সত্যি। একটু আগে বইয়ের উপরে আঙুল দিয়ে দাগ দিয়ে বইয়ের ভিতর ক্রস একে ফেলেছে।”
টুম্পা বলল, “আমাদের দেখাবে?”
মিশু বলল, “অন্য সময় দেখাব। এখন বরং তোমাকে চায়ের ম্যাজিক দেখাই।”
“দেখাও।”
মিশু বলল, “ঠোটগুলো যতোটুকু পার ভেতরে নাও তারপর চা খাও দেখবে কী ম্যাজিক হবে! যতো বেশী মুখের ভেতর নিতে পারবে তত বড় ম্যাজিক।”ব
সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল টুম্পা তার ঠোট দুটো মুখের ভেতরে নিয়ে তার চায়ে চুমুক দিতে গিয়েই চিৎকার করে চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে প্রায় কাঁদতে শুরু করে দিল।
সবাই ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”
টুম্পা হাত দিয়ে তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। মিশু হা হা করে হেসে বলল, “কী আর হবে? কিছু হয় নাই! মুখে গরম চায়ের একটু ছ্যাকা খেয়েছে। মানুষের ঠোট গরম সহ্য করতে পারে, অন্য জায়গা পারে না, সেটাই দেখানো হলো!”
মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে কেউ নজর দিল না, টুনি টুম্পাকে হাত ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেল, ফ্রীজ থেকে এক টুকরো বরফ বের করে তার ঠোটে লাগিয়ে দিল যন্ত্রণাটা কমানোর জন্যে। মিশু তখনো দুলে দুলে হাসছে। ঝুমু খালা কোমড়ে হাত দিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি মানুষটা তো ভালো না, ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাও!”
মিশু হাসি হাসি মুখে, বলল, “কষ্ট? কষ্ট কখন দিলাম? গরম চায়ে শুধু একটু ছ্যাকা খেয়েছে! একটু মজা করলাম আর কিছু না।”
ঝুমু খালা বলল, “এই বাসায় এই রকম মজা চলে না।”
মিশু তখনো হাসি হাসি মুখ রেখে বলল, “ঠিক আছে! এই বাসায় যেরকম মজা চলে সেটাই করা হবে এখন থেকে। সেটা হচ্ছে লুডো টুর্নামেন্ট! ঠিক আছে?”
সবাই মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা নাড়ল।

মিশু খুবই বুদ্ধিমান এবং লেখাপড়া জানা ছেলে, দেখতেও খুব সুন্দর, কাপড় জামা ভালো, কথা বলে খুব সুন্দর করে কিন্তু মানুষটা মনে হয় ভালো না, ঝুমু খালা সেটা টের পেয়েছে সবার আগে। অন্যেরাও আস্তে আস্তে টের পেতে লাগল।
যেমন সন্ধ্যেবেলা মিশু বাসায় এসে টুম্পাকে খুঁজে বের করে বলল, “টুম্পা তোমাকে বিকেলে গরম চা দিয়ে ছ্যাকা খাইয়েছি সেজন্যে আমার খুব খারাপ লাগছে। তোমার সাথে ভাব করার জন্যে আমি তোমার জন্যে একটা চকলেট কিনে এনেছি। তুমি চকলেট খাও তো?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, চকলেট তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। বড় হয়ে সে চকলেটের ফ্যাক্টরী তৈরি করবে বলে ঠিক করে রেখেছে।
মিশু বলল, “আমি চকলেটটা দিচ্ছি, কিন্তু তুমি তার আগে আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবে?”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ?”
মিশু টুম্পার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলল, “এই কাগজটা ভাঁজ করে দিতে পারবে?”
টুম্পা বলল, “পারব।”
তাহলে ভাঁজ করে দাও দেখি, “সাতবার ভাঁজ করবে।”
টুম্পা বলল, “সাতবার?”
“হ্যাঁ। সমস্যা আছে?”
টুম্পা বলল, “নাহ্।”
মিশু বলল, “তাহলে শুরু করে দাও, আমি চকলেটটা বের করে রাখি। ভাঁজ শেষ হলেই চকলেট!”
টুম্পা কাগজটা মাঝখানে একবার ভাঁজ করল। তারপর আবার। তারপর আবার। ভাঁজ করার জন্যে কাগজটা মোটা হতে শুরু করেছে তাই আস্তে আস্তে কাজটা কঠিন হয়ে গেল। টুম্পা অনেক কষ্ট করে ছয়বার ভাঁজ করে আবিষ্কার করল কাগজটা সাতবার ভাঁজ করা অসম্ভব।
মিশু মুখের মাঝে একটা কপট দুশ্চিন্তার ভান ফুটিয়ে বলল, “কী হলো? থেমে গেল কেন? করো।”
টুম্পা বলল, “করা যাবে না।”
মিশু বলল, “আহা-হা-তাহলে তো চকলেটটাও তোমাকে দেয়া যাবে না। তোমার জন্যে এনেছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে আমাকেই খেতে হবে!” বলে চকলেটটার র‌্যাপার খুলে সত্যি সত্যি সে খেতে শুরু করল।
লজ্জায় আর অপমানে টুম্পার চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে ঘর থেকে প্রায় ছুটে বের হলে গেলে। কাছেই দাড়িয়ে শান্ত পুরো ব্যাপারটা দেখেছে সে মাথা নেড়ে বলল, “কাজটা ভালো হল না।”
মিশু চকলেটের বারে আরেকটা বড় কামড় দিয়ে বলল,“কোন কাজটা?”
“টুম্পাকে এরকম লজ্জা দিলে? বেচারী—”
“লজ্জা দিয়েছি? আমি? মোটেও না।”
“টুম্পা কেমন করে জানবে একটা কাগজ সাতবার ভাঁজ করা যায় না?”
“জানা উচিৎ ছিল। প্রতিভাঁজে কাগজের সংখ্যা ডাবল হয়ে যায়। সাত ভাঁজ মানে চৌষট্টি পাতা— একশ আঠাইশ পৃষ্ঠা! একশ আঠাইশ পৃষ্ঠার একটা বই ভাঁজ করতে রাজী হওয়ার আগে চিন্তা করা উচিৎ ছিল।”
শান্ত বলল, “টুম্পা ছোট একটা মেয়ে—”
মিশু চকলেটের শেষ টুকরোটা মুখে দিয়ে খুব তৃপ্তি করে চিবুতে চিবুতে বলল,“ঠিক আছে টুম্পা ছোট মেয়ে— কিন্তু তুমি তো ছোট না। তুমি কী রাজী আছ?”
শান্ত বলল, “কীসে রাজী আছি?”
“আমি যেটা বলব সেটা করতে রাজী আছ?”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “কী করতে বলবে?”
“খুব সোজা একটা কাজ। যদি করতে পার তাহলে আমি তোমাকে একশ টাকা দিব। না পারলে তুমি আমাকে একশ টাকা দিবে।”
শান্ত সরু চোখে কিছুক্ষণ মিশুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল তারপর বলল, “আমার কাছে এতো টাকা নাই।”
“কতো আছে?”
“দশ টাকা।”
“ঠিক আছে তুমি করতে পারলে আমি তোমাকে একশ টাকা দিব, না পারলে তুমি আমাকে দশ টাকা দিবে।”
“কাজটা কী আগে শুনি।”
মিশু বললম “তুমি তোমার এক পায়ের উপর দাড়াবে।”
শান্ত অবাক হয়ে বলল, “ব্যাস?”
“হ্যাঁ। তবে কোথায় দাড়াতে হবে সেটা আমি বলে দেব। জায়গাটা যদি তোমার পছন্দ না হয় তোমার দাড়াতে হবে না। দেখে শুনে যদি রাজী হও তাহলেই শুধু দাড়াবে।”
“কতোক্ষণ দাড়াতে হবে?”
মিশু বলল, “এক সেকেন্ড।”
শান্ত বলল, “মাত্র এক সেকেন্ড?”
“হ্যাঁ। মাত্র এক সেকেন্ড।”
“ঠিক আছে, কোথায় দাড়াতে হবে দেখাও।”
মিশু বলল, “আগে সবাইকে ডেকে আনো। সবার সামনেই কম্পিটিশনটা হোক। পরে বলবে আমি বোকা পেয়ে তোমাকে ঠকিয়ে দিয়েছি।”
শান্ত গরম হয়ে বলল, “আমি বোকা না।”
মিশু বলল, “ঠিক আছে, তুমি বোকা না। তবে জেনে রাখো বোকা না হওয়া এক জিনিষ আর বুদ্ধিমান হওয়া অন্য জিনিষ।”
শান্ত সরু চোখে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল। মিশু বলল, “যাও সবাইকে ডেকে নিয়ে এসো! আমাদের কম্পিটিশনটা দেখুক।”
কিছুক্ষণের মাঝেই সব বাচ্চারা হাজির হল। মিশু সবার দিকে তাকিলে বলল, “আমার আর শান্তর মাঝে এখন একটা প্রতিযোগিতা হবে। আমি শান্তকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাড়াতে বলব। সে যদি এক সেকেন্ড সেখানে এক পায়ে দাড়াতে পারে আমি তাকে দেব একশ টাকা। যদি না পারে সে আমাকে দেবে মাত্র দশ টাকা।”
মুনিয়া বলল, “আমিও এক পায়ে দাড়াতে পারি। এই দেখ—” বলে সে এক পায়ে দাড়িয়ে গেল।”
মিশু হাসি হাসি মুখে বলল, “ভেরি গুড। যখন তোমার সাথে কম্পিটিশান হবে তখন তুমি দাড়াবে। এখন কম্পিটিশনটা হচ্ছে শান্তর সাথে।” মিশু শান্ত এর দিকে তাকিয়ে বলল, “শান্ত, রেডি?”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “রেডি।”
“তাহলে ঐ দেয়ালের কাছে গিয়ে দাড়াও ডান পায়ের ডান সাইডটা দেয়ালে লাগিয়ে বাম পা’টা এক সেকেন্ডের জন্যে উপরে তুলবে। বেশি না,মাত্র এক সেকেন্ড!”
শান্ত হাসি হাসি মুখে গেল, ডান পায়ের ডান দিকের অংশটা দেয়ালের সাথে লাগালো এবং হঠাৎ করে সবাই দেখল শান্ত এর মুখটা কেমন যেন চিমশে মেরে গেল। মনে হচ্ছে ডান পায়ের উপর ভর দিয়ে সে বাম পা’টা তুলতে পারছে না! এক সেকেন্ডের জন্যেও না! কী আশ্চর্য!
মিশু বলল, “কী হল দাড়িয়ে আছ কেন? তোলো বাম পা, ডান পায়ের উপর দাড়াও।”
শান্ত বোকার মত একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “পারছি না!” তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে একটুখানি তুলে সাথে সাথে নামিয়ে ফেলল, বোঝাই যাচ্ছে সে দেয়ালের সাথে এক পা এবং শরীর লাগিয়ে অন্য পা তুলতে পারবে না।
মিশু হাত পেতে বলল, “দাও আমার দশ টাকা।”
শান্ত মুখটা কালো করে পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে মিশুকে দিল। টাকাটার জন্যে তার খুব দুঃখ নেই কিন্তু সবার সামনে সে যে বোকা বনেছে সে জন্যে তার খুবই লজ্জা লাগছিল।
শান্ত এর অবস্থা দেখে অন্য সবাই চেষ্টা করে আবিস্কার করল দেয়ালের সাথে পা এবং শরীর লেগে গেলে কোনোভাবেই এক পায়ে দাড়ানো যায় না। মিশু মুখ গম্ভীর করে বলল, “পারবে না। এটা সম্ভব না। এক পায়ে দাড়ালে শরীরের সেন্টার অফ গ্রেভিটি ব্যালেন্স করার জন্যে শরীরটা বাঁকাতে হয়। দেওয়াল থাকলে শরীর বাকাঁনো যায় না তাই এক পায়ে দাড়ানোও যায় না।”
মিশুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনেও কেন জানি কেউই খুব চমৎকৃত হল না।

রাতে ঘুমানোর সময় মিশু শান্তকে জীবন সম্পর্কে একটু জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করল। বলল, “বুঝলে শান্ত, “বেশী ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে ঠিক জায়গায় দুই নম্বুরী করতে হয়।”
শান্ত উঠে বসল, “তুমি দুই নম্বুরী কর?”
“করি না? সব সময় করি। করতে হয়। যেমন মনে কর পরীক্ষার সময় তুমি খুব ভালো পরীক্ষা দিলে, কিন্তু অন্যরা তোমার থেকেও ভালো পরীক্ষা দিল, তাহলে তোমার লাভ কী? তাই পরীক্ষার সময় তোমার ভালো পরীক্ষা দেওয়া যেমন দরকার, অন্যদের পরীক্ষা খারাপ করে দেওয়া সমান দরকার।”
“অন্যদের পরীক্ষা তুমি কেমন করে খারাপ করবে?”
“অনেক রকম উপায় আছে। তোমাকে সোজা একটা উপায় শিখিয়ে দেই। ক্যালকুলেটরে ডিগ্রী থাকে আর রেডিয়ান থাকে। ছেলেমেয়েরা সবসময় ডিগ্রীতে হিসাব করে। আমি কী করি জান?”
“কী কর?”
“ওদের ক্যালকুলেটর নিয়ে সেটাকে রেডিয়ানে সেট করে দেই। তারা তো আর সেইটা জানে না, তাই যখন ত্রিকোণমিতি করে সব হিসাব তখন ভুল হয়ে বের হয়! পরীক্ষায় এতো বড় গোল্লা পায়—” কথা শেষ করে মিশু আনন্দে হা হা করে হাসতে থাকে।
শান্ত ঠিক বুঝতে পারছিল না অন্যদের পরীক্ষায় গোল্লা পাইয়ে দেওয়াটা ঠিক কাজ হচ্ছে কী না। কিন্তু কেউ তো অস্বীকার করতে পারবে না মিশু ভাইয়া খুবই ভালো ছাত্র, ভর্তি পরীক্ষায় সবগুলি ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে! কাজেই সে যে কাজগুলো করে সেটা নিশ্চয়ই সঠিক কাজ। তবু তার ভিতরে খচ খচ করতে থাকে।

পরদিন লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হল। ছোট একটা টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার, সেখানে খেলোয়াড়রা বসবে। টেবিলে লুডোর বোর্ড। টেবিল ঘিরে দর্শকেরা বসে কিংবা দাড়িয়ে চিৎকার করে খেলোয়ারদের উৎসাহ দেবে। অনেক কষ্ট করে একশ টাকা জোগাড় করা হয়েছে। টুর্নামেন্টের বিজয়ীকে এই একশ টাকা নগদ দেয়া হবে। টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করার জন্যে দাদী (কিংবা নানী) কে ধরে আনা হল, দাদীর সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। প্রথমে দাদীকে বলা হল একটা বক্তৃতা দিতে। দাদী অবাক হয়ে বললেন, “বক্তৃতা? আমি?”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ, তুমি।”
দাদী বললেন, “আমি কখনো বক্তৃতা দেই নাই। কেমন করে বক্তৃতা দিতে হয় জানি না।”
শান্ত বলল, “বক্তৃতা কেমন করে দিতে হয় কেউ জানে না! শুধু হাত উপরে তুলে গলা কাঁপিয়ে বলো, ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক।”
দাদী অবাক হয়ে বলল, “ধ্বংস হোক? কে ধ্বংস হবে?”
“সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মেহনতি মানুষের শত্রু— এইসব।”
প্রমি শান্তকে ধমক দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি?” তারপর দাদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “লুডো খেলা নিয়ে কিছু একটা বল।”
দাদী তখন গলা খাকারী দিয়ে বলল, “মুনিয়া বেচারী লুডো খেলতে চাচ্ছিল তোরা কেউ আগে খেলতে চাস নাই সে জন্যে মুনিয়ার খুব মন খারাপ ছিল। এখন তোরা খেলার আয়োজন করেছিস দেখে খুশী হলাম। দোয়া করি তোদের প্রতি দানে যেন বেশী করে ছক্কা উঠে।”
দাদীর বক্তৃতা শেষ হতেই সবাই জোরে জোরে হাত তালি দিল। তখন প্রমি ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা এখন তুমি একটা বক্তৃতা দাও।”
ঝুমু খালা এক কথায় রাজী। শাড়ীটা কোমরে প্যাচিয়ে হাত নেড়ে বক্তৃতা শুরু করে দিল, “দেশবাসী ভাই বোনেরা আপনাদের লাল সালাম (প্রচন্ড হাত তালি শোনা গেল)। এই বাসার পুলাপান কিছু পাগল কিছু আধা পাগল (আবার হাত তালি) তারপরেও তোমরা একটা লুডু খেলার আয়োজন করেছ সেই জন্যে লাল সালাম (আবার হাত তালি)। আমি এইখানে ঘোষণা দিয়ে গেলাম লুডু খেলা চলার সময় আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোমাদের চা নাস্তা দিয়ে যাব।”
ঝুমু খালার কথা শেষ হবার পর এবারে শুধু হাততালি না জঙ্গী শ্লোগান শোনা গেল, “আমার খালা, তোমার খালা। ঝুমু খালা ঝুমু খালা।”
তারপর দাদী লুডোর বোর্ডের উপর একবার ছক্কাটা চাললেন, খেলার উদ্বোধন হয়ে গেল।

কার সাথে কে খেলবে খুব যত্ন করে সেটা তৈরী করা হয়েছে। তিনবার করে খেলা হবে তার মাঝে যে দুইবার জিতবে সেই হচ্ছে বিজয়ী। খেলা শুরু হওয়ার আগে মিশু জিজ্ঞেস করল, “এই লুডু টুর্নামেন্টে কে জিতবে বলে তোমাদের মনে হয়?”
কেউ কিছু বলার আগেই মুনিয়া হাত তুলে বলল, “আমি!”
“তুমি?” মিশু বলল, “তুমি কেমন করে জান তুমি চ্যাম্পিয়ন হবে?”
মুনিয়া বলল, “আমি খুব ভালো লুডো খেলতে পারি। আর আমি যখন চ্যাম্পিয়ন হব তখন আমি একশ টাকা পাব। আমার একশ টাকা দরকার।”
“এতো ছোট মানুষ তুমি এতো টাকা দিয়ে কী করবে?”
মুনিয়া মাথা নাড়ল, বলল, “বলব না।”
মিশু বলল, “মুনিয়া তুমি কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হবে না। শুধু শুধু আশা করে বসে থেকো না।”
মুনিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, “হব না?”
”নাহ্। চ্যম্পিয়ন হব আমি। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”
”সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” মিশু মাথা নাড়ল, “লুডো খেলার মাঝে আমি হচ্ছি সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট। আমাকে কেউ হারাতে পারবে না।”
মুনিয়ার ছোট মুখটা একটু কালো হয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে সাহস দিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মিশু মুনিয়াকে বলল, “কিন্তু তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে আগেই তোমার জন্যে একশ টাকা বের করে দেব।”
মুনিয়া অবাক হয়ে বলল, “কোথা থেকে বের করবে।”
“তোমার কাছেই আছে।”
“আমার কাছে আছে?”
মিশু বলল, “হ্যাঁ। এই দেখ—” বলে মুনিয়ার কানটা স্পর্শ করে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে আনে। সেটা দেখে মুনিয়ার মুখটা হা হয়ে গেল। তার কানের ভেতর পাঁচ টাকার এতো বড় একটা কয়েন আছে সে কখনো জানতো না।
মিশু বলল, “কয়েনগুলো রাখার জন্যে কিছু একটা দরকার।” দেখা গেল সে রেডি হয়ে এসেছে। কফি টেবিলের উপর রাখা একটা খালি কৌটা নিয়ে সেখানে ঝন করে পাঁচ টাকার কয়েনটা ফেলে আবার মুনিয়ার অন্য কান থেকে আরেকটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে আনে। তারপর নাক থেকে দুইটা কয়েন বের করে আনে। চোখ থেকে, চুল থেকে ঘাড় থেকে কয়েন বের হতে থাকে আর মিশু কয়েনগুলো টিনের কৌটার মাঝে রাখতে থাকে। যখন মুনিয়ার শরীর থেকে বিশটা পাঁচ টাকার কয়েন বের হয়েছে তখন মিশু বলল, “এই যে মুনিয়া একশ টাকা হয়ে গেছে। তোমাকে তোমার একশ টাকা দিয়ে দিই। সব কৌটার মাঝে জমা করে রেখেছি।”
মুনিয়া ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে কী না বুঝতে পারছে না। কিন্তু অবিশ্বাসই বা করে কেমন করে? নিজের চোখে দেখেছে মিশু ভাইয়া তার কান থেকে নাক থেকে কয়েনগুলো বের করছে। সে টুনির দিকে তাকালো, টুনি বলল, “মিশু ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করিস না। এগুলো ম্যাজিক। হাতের কারসাজি। তোর সাথে ঠাট্টা করছে।”
মিশু গম্ভীর মুখে বলল, “মোটেও কারসাজি না। এই দেখ কয়েনগুলো কৌটার মাঝে আছে।” মিশু কৌটাটা ঝাকুনি দিতেই ভেতরে কয়েনগুলো ঝনঝন করে উঠল। তারপর কৌটার মুখে তার প্লাস্টিক ঢাকনাটা লাগিয়ে কৌটাটা তাকে দিয়ে বলল, “নাও। তোমার জন্যে।”
মুনিয়া আগ্রহ নিয়ে কৌটাটা নিল। মিশু বলল, “শুধু মুখটা খোলার সময় সাবধান।”
“কেন?”
“এটা খোলার সময় তুমি যেটা ইচ্ছা চিন্তা করতে পারো কিন্তু হাতির কথা চিন্তা করতে পারবে না। হাতির কথা চিন্তা করলেই কিন্তু কয়েনগুলো ভ্যানিস হয়ে যাবে।”
“ভ্যানিস হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
মুনিয়া কয়েকবার কৌটার মুখটা খুলতে গিয়ে থেমে গেল। প্রত্যেকবার খোলার সময় তাকে নিশ্চিত হতে হয় সে যে হাতির কথা চিন্তা করছে না, তখন হাতির কথা মনে পড়ে যায়।
টুনি মুনিয়ার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, “মিশু ভাইয়া তোকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এই কৌটার ভিতরে কিছু নেই। তুই খুলে দেখ।”
মুনিয়া কৌটাটা খুলে চিৎকার করে সেটা ছুড়ে ফেলে দিল। ভিতরে একটা মরে শুকনো হয়ে থাকা টিকটিকি। কী ভয়ানক! একটু আগে শান্তর ঘরে জানালার ফাঁকে আটকে পড়ে মরে পরে থাকা এই টিকটিকিটা মিশু আবিষ্কার করে এখনই একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে!
মিশু দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই কৌটা খোলার সময় হাতির কথা চিন্তা করেছ তাই সব কয়েন ভ্যানিস করে একটা মরা টিকটিকি চলে এসেছে!”
মুনিয়া বিষদৃষ্টিতে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল।

কিছুক্ষণের ভিতরে লুডো টুর্নামেন্ট শুরু হয়। মিশু ঘোষণা দিয়ে রেখেছে কেউ তাকে খেলায় হারাতে পারবে না। দেখা গেল তার কথা সত্যি। সে অবলীলায় প্রথম খেলাটা জিতে গেল। মনে হলো ছক্কাটা তার কথা শুনে, যখনই ছয়ের দরকার হয় একটা ছয় উঠে আসে। লুডো খেলায় এরকম ছয়ের ছড়াছড়ি সে আগে দেখেনি!
দ্বিতীয় খেলার সময়ও দেখা গেল ঝটপট মিশুর সবগুটি বোর্ডে উঠে এসেছে, তারপর দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। টুনি তখন মিশুর খেলাটা ভালো করে লক্ষ করল এবং মিশুর জিতে যাওয়ার কারণটা কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করে ফেলল।
মিশুর কাছে দ্বিতীয় একটা ছক্কা আছে যেটা দেখতে হুবহু আসল ছক্কার মতন। কিন্তু সেই ছক্কাটিতে কোনো পাঁচ নেই, পাচেঁর বদলে সেখানে আরো একটি ছয় আছে। এই ছক্কাটি দিয়ে খেললে ছয় ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে ডাবল হয়ে যায়। মিশুর যখন ছয়ের দরকার হয় সে এটা দিয়ে খেলে। মিশু যেহেতু ম্যাজিক দেখায়, তার হাত সাফাই অসাধারণ। হাতের মাঝের লুকিয়ে রাখা ছক্কাটা কেমন করে বদলে দেয় তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও ধরা যায় না। ছক্কাটা যখন গড়িয়ে যায় তখন খুব ভালো করে তাকালে বোঝা যায় এই ছক্কার দুই পাশেই ছয়। টুনি মিশুকে ধরিয়ে দিবে কী না চিন্তা করল, কিন্তু মিশুর মতো ধুরন্ধর ছেলেকে শুধু ধরিয়ে দিলে হবে না তাকে একটা শিক্ষাও দেয়া দরকার। টুনি তখন লুডো টুর্নামেন্ট থেকে উঠে উপরে গেল। শাহানা আপু ভরসা। যখন তার নিজের বুদ্ধিতে কুলায় না তখন সে শাহানা আপুর বুদ্ধি ধার নেয়।
শাহানা আপু খাতায় বিদঘুটে যন্ত্রের একটা ছবি এঁকে তার দিকে তাকিয়েছিল, টুনিকে দেখে বলল, “লুডো টুর্নামেন্ট কেমন চলছে?”
“ভালো, কিন্তু একটা সমস্যা আছে। তাই তোমার কাছে এসেছি।
“কী সমস্যা?”
“মিশু ভাইয়া একটা দুই নম্বরী ছক্কা দিয়ে খেলছে।”
“দুই নম্বরী?”
“হ্যাঁ। এই ছক্কায় কোনো পাঁচ নেই। ছক্কার এই পিঠ আর ওই পিঠ দুই পিঠেই ছয়। সেটা চাললে বেশী ছয় উঠে।”
“ধরিয়ে দিচ্ছিস না কেন?”
“ধরিয়ে দিলেই তো শেষ। আমি ধরিয়ে দেবার আগে মিশু ভাইয়াকে একটা শিক্ষা দিতে চাই। মিশু ভাইয়া মানুষটা ভালো না— মুনিয়াকে একটু আগে বোকা বানিয়ে হা হা করে হাসছে। যে মানুষ ছোট বাচ্চাদের জ্বালায় সেই মানুষ খুব ডেঞ্জারাস।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল,“তুই কী করতে চাস?”
“আমাকে এমন একটা ছক্কা বানিয়ে দেবে যেটা দিয়ে যখন যেটা পেতে চাই সেটা পাব। ছয় চাইলে ছয় তিন চাইলে তিন। এক চাইলে এক।”
“কখন বানিয়ে দেব?”
“এই এক্ষুনি। বিকালের মাঝে টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাবে তার আগে।”
শাহানা আপু হাসল, বলল, “এতো তাড়াতাড়ি এই রকম ছক্কা বানানো সম্ভব না। মিশু ভাইয়ার মতো আরেকটা ছক্কা বানিয়ে নে।”
টুনি মাথা নাড়ল, “উহুঁ। আমি মিশু ভাইয়ার নকল করতে চাই না। নূতন কিছু করতে চাই যেন মিশু ভাইয়া টের পায় যে তার থেকে বুদ্ধিমান মানুষ আছে যে তাকে ঘোল খাওয়াতে পারে।”
শাহানা আপা ঠোট সূচাঁলো করে উপরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা কাজ করা যেতে পারে।”
টুনি হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমি বলেছি না, তুমি চাইলেই পারবে। বল কী করতে হবে।”
“যেহেতু মেঝেতে বোর্ড পেতে খেলা হচ্ছে না, একটা ছোট টেবিলের উপর রেখে খেলা হচ্ছে তাই এই বুদ্ধি কাজে লাগানো যায়।”
“কী বুদ্ধি বল।”
আমার কাছে ছোট ছোট খুব পাওয়ারফুল চুম্বক আছে। নষ্ট হার্ড ড্রাইভ থেকে বের করেছি। একটা ছক্কা নিয়ে মাঝখানে গর্ত করে সেই চুম্বকটা ঢোকাতে হবে। কাজটা সহজ না কিন্তু সম্ভব। ছক্কাটা মাঝখান থেকে কেটে ভেতরে গর্ত করে সেখানে এই খুব ছোটো বিন্দি চুম্বকটা ঢোকাতে হবে। তারপর আবার দুই অংশ জুড়ে দিয়ে পালিশ করে নিয়ে ছক্কার ডটগুলো নূতন করে এঁকে দিতে হবে।”
“তারপর কী করব?”
“এটাকে দেখতে ছক্কার মত মনে হলেও এটা আসলে একটা পাওয়ারফুল চুম্বক। আরেকটা চুম্বক দিয়ে এটাকে কন্ট্রোল করা যাবে। মনে কর এমনভাবে ছক্কাটা তৈরি হল যেন ছক্কাটার নর্থপোল যখন নিচের দিতে থাকবে তখন ছয় উঠবে। আর যখন সাউথ পোল নিচের দিকে থাকবে তখন এক উঠবে। এবারে কেউ যখন খেলার সময় ছক্কাটা মারবে, টেবিলের নিচে আরেকটা চুম্বক ধরবি, যদি সেই চুম্বকটার সাউথ পোল উপরের দিকে রাখিস তাহলে সেই সাউথ পোলের আকর্ষণে ছক্কাটার নর্থ পোল নিচের দিকে চলে আসবে অর্থাৎ ছয় উঠবে।”
তূনি মাথা নাড়লো, বলল, “বুঝেছি। আর যদি চুম্বকটা উলটো করে ধরি তাহলে এক উঠবে।”
শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
টুনি শাহানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “প্লীজ, শাহানা আপু আমাকে এই ম্যাজিক ছক্কাটা বানিয়ে দাও। প্লীজ প্লীজ প্লীজ।”
শাহানা বলল, “ঠিক আছে আমাকে ঘণ্টাখানেক সময় দে। ছক্কাটা বানাব কী দিয়ে সেটা আগে ঠিক করি।”
টুনি বলল, “আমার কাছে আরেকটা লুডো সেট আছে সেখানে একটা ছক্কা আছে, সেটা নিয়ে আসি?”
“যা নিয়ে আয়।”
টুনি ছুটে উপরে গিয়ে তার টেবিলের তাকের উপর থেকে লুডো সেটের ছক্কাটা নিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে এসে শাহানার হাতে ধরিয়ে দিল।
এখন যে ছক্কাটা দিয়ে টুর্নামেন্ট খেলা হচ্ছে এটা তার থেকে একটু বড়, দেখতেও অন্যরকম, ঠিক টুনি যেরকম চাইছিল।

নিচে তখন লুডো টুর্নামেন্ট খুব জমে উঠেছে। সব খেলোয়াড়দের দুই গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে এক গ্রুপে মিশুকে কেউ হারাতে পারেনি। সে নিশ্চিতভাবে ফাইনাল খেলবে। অন্য গ্রুপ থেকে ফাইনালে কে আসবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব ছিল না কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে যে মুনিয়া উঠে আসবে। মুনিয়া ভালো খেলছে সেটা নয়, সবাই প্রাণপন চেষ্টা করছে মুনিয়াকে জিতিয়ে দিতে।
যখনই কেউ মুনিয়ার বিপক্ষে খেলছে তখনই সে ইচ্ছে করে ভুল চাল দিয়ে হেরে যাচ্ছে। লুডো খেলায় সেটা খুব সহজ, যখন একটা গুটি পেকে যাবার কথা তখন ভুল করার ভান করে দ্বিতীয়বার ঘুরিয়ে আনা যায়। শুধু তাই না মুনিয়া যেন কেটে ফেলতে পারে সে জন্যে ইচ্ছে করে তার সামনে বিপজ্জনকভাবে সবাই নিজের গুটি ফেলে রাখে। মুনিয়া ছোট মানুষ তাই সে বুঝতে পারছে না যে সবাই ইচ্ছে করে তার সাথে হেরে যাচ্ছে! তার ধারণা সে নিজেই অসাধারণ লুডো খেলে জিতে যাচ্ছে। সে খুবই খুশী।
টুনি গিয়ে শান্তকে খুঁজে বের করল, তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলল, “শান্ত ভাইয়া তুমি একটা কাজ করে দেবে?”
“কতো দিবি?”
টুনি মুখটা শক্ত করে বলল, “তুমি টাকা ছাড়া আর কিছু বুঝো না? কাজটা কী না শুনেই জিজ্ঞেস করলে কতো দিব?”
“নিশ্চয়ই তোর কোনো একটা ফিচলে বুদ্ধির কাজ করতে হবে। টাকা ছাড়া হবে না।”
“আগে শুনে দেখো কী কাজ।”
“ঠিক আছে, বল।”
“আমি যখন বলব তুমি তখন লুডো খেলার এই ছক্কাটা কোনোভাবে গায়েব করে দেবে যেন আর কেউ খুজে না পায়।”
শান্ত চিন্তিত মুখে বলল, “তাহলে লুডো খেলবে কেমন করে? টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে না?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, না টুর্নামেন্ট বন্ধ হবে না। আমার কাছে অন্য ছক্কা আছে।”
“তার মানে তুই ছক্কাটা বদলে দিতে চাস?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এখন জানতে চেয়ো না, পরে বলব।”
“শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে। দশ টাকা।”
“আগে কাজ শেষ করো তারপর টাকা।”
“দিবি তো?”
“দিব। তুমি আর একটা কাজ করে দেবে?”
“কতো টাকা?”
টুনি মাথা নাড়ল, “উহুঁ, এটার জন্যে কোনো টাকা নাই। আমাদের টুর্নামেন্টের ছবি তুলে দাও। ছবি আর ভিডিও। মিশু ভাইয়া যখন খেলে তখন লুডো বোর্ডের ভিডিও!”
“লুডো বোর্ডের ভিডিও?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“পরে বলল।”
“ঠিক আছে।”

শাহানা বলেছিল তাকে ঘণ্টা খানেক সময় দিতে। কিন্তু সে আধা ঘণ্টার মাঝে ম্যাজিক ছক্কাটা তৈরি করে দিল। দেখে বোঝার উপায় নেই এই ছক্কার মাঝে এতো ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। চোখের কাছে নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে বোঝায় এটা মাঝখানে কেটে আবার জোড়া দেয়া হয়েছে।
শাহানা টুনির হাতে ছক্কা আর একটা চুম্বক দিল। টুনির ধারণা ছিল চুম্বক মানেই একটা লোহার বার, এক পাশে লাল অন্য পাশে কালো রং করা। কিন্তু শাহান দিল চ্যাপটা মত একটা ধাতব টুকরো, এইটা নাকি চুম্বক। তারপর সেটা শাহানার টেবিলের উপর পরীক্ষা করল, টেবিলের উপর ছক্কাটা ছেড়ে দিয়ে টুনি নিচে চুম্বকটা ধরতেই ছক্কাটা কেমন জানি লাফ দিয়ে ছয় উঠে গেল! যতবার পরীক্ষা করল ততবার ছয়! আবার চুম্বকটা উল্টে ধরতেই ছয়ের বদলে এক উঠতে লাগল। যতবার পরীক্ষা করল ততবার এক। আর যখন চুম্বকটা নিচে রাখে না তখন এই ছক্কাটা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা ছক্কা। টুনি খুশীতে শাহানাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “আপু তুমি একটা জিনিয়াস।”
শাহানা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছে বলল, “একটা ছক্কাকে ইঞ্জিনিয়ারিং করতে জিনিয়াস হতে হয় না!”

টুনি তার ম্যাজিক ছক্কাটা দিয়ে যখন নিচে নেমে এসেছে তখন মুনিয়া আর শান্ত এর মাঝে সেমি ফাইনাল খেলা হচ্ছে। অন্য গ্রুপের বিজয়ী হিসেবে মিশু জিতে এসেছে। এখন এই খেলাটিতে মুনিয়া জিতে গেলে সে মিশুর সাথে ফাইনাল খেলবে। সবাই মুনিয়ার পক্ষে, শান্ত নিজেও মুনিয়ার পক্ষে যদিও সে সেটা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। প্রত্যেকবার ছয় ওঠার পর সে আনন্দের ভান করে এমন চিৎকার চেচামেচি হই চই করতে থাকে যে মনে হয় সে বুঝি লটারীতে লক্ষ টাকা পেয়ে গেছে। মুনিয়াকে জেতানোর জন্যে সে তার পাকা গুটিগুলো তাকে খেতে দিচ্ছে কিন্তু প্রত্যেকবার তার একটা গুটি কাটা পড়লে সে যেভাবে চিৎকার করে আহাজারি করার ভান করতে থাকে যে দেখে মনে হয় গুটি নয় সে নিজেই বুঝি কাটা পড়েছে!
দেখতে দেখতে খেলা শেষ হয়ে গেল, মুনিয়া জিতে গিয়েছে এখন মিশুর সাথে ফাইনাল খেলা হবে। ঝুমু খালা এই মাত্র গরম গরম পিয়াজো ভাজা আর কোল্ড ড্রিংক্স নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে সেগুলো খেলো, তারপর ফাইনাল খেলা শুরু হলো। ছোট টেবিল ঘিরে দর্শকদের ভীড় তার মাঝে টুনি তার চুম্বকটা টেবিলের নিচে ধরে উপরে ছক্কাটাকে নাচাতে পারবে।
খেলা শুরু হল। প্রথম মুনিয়া চাললো, একটা তিন উঠেছে। এরপর মিশু, টুনি লক্ষ্য করল খুব পাকা হাতে সে ছক্কাটা বদলে নিজের দুই নম্বরী ছক্কাটী দিয়ে খেলছে। সত্যি সত্যি ছয় উঠে গেল। সবাই একটা দীর্ঘশ্বাসের মত শব্দ করল শুধু টুনি শান্তভাবে বসে রইল, তার ভেতরে কোনো দুর্ভাবনা নেই। মিশু আরেকবার চালল, এবারে তিন উঠেছে। টুনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মিশুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট দেখতে পেল মিশু দুই নম্বরী ছক্কাটা বদলে আবার আগের ছক্কাটি দিয়ে দিয়েছে। টুনি তখন শান্ত এর দিকে তাকিয়ে ছক্কাটি গায়েব করে দেওয়ার ইঙ্গিত করল।
শান্ত হঠাৎ হুংকার দিয়ে বলল, এই পাজী বদমাস বেয়াদব ছক্কাটাকে একটা শাস্তি দেয়া দরকার। কতো বড় বদমাস ছক্কা, মুনিয়ার উঠেছে তিন আর মিশু ভাইয়ার বেলায় একটা ছয় আরেকটা তিন! পাজীর পা ঝাড়া—”
মিশু বলল, “ছক্কার উপর রাগ হয়ে লাভ নেই। এটা হচ্ছে ভাগ্য।”
শান্ত বলল, “ভাগ্যের খেতাপুড়ি।” তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে লুডো বোর্ড থেকে ছক্কাটাকে নিয়ে নিচে ফেলে সেটাকে পা দিয়ে লাথি দিতে থাকল। তাতেও তার রাগ কমল বলে মনে হল না, তখন কোথা থেকে একটা হাতুড়ি বের করে ছক্কাটাকে এক হাতুড়ির আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
সবাই এতো অবাক হল যে বলার মত নয়! প্রমি বলল, “শান্ত! তুই একটা পাগল নাকি? ছক্কাটাকে গুড়ো করে ফেললি?
টুম্পা বলল, “এখন খেলবে কেমন করে?”
মুনিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তাহলে আমরা খেলতে পারব না?
টুনি বলল, “দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আমার কাছে আরেকটা লুডোর সেট আছে সেখান থেকে ছক্কাটা নিয়ে আসি।”
প্রমি বলল, “যা। নিয়ে আয়।”
টুনি বলল, “আমার জায়গাটা যেন কেউ না নেয়।”
প্রমি বলল, “কেউ নেবে না।”
সবাই যখন শান্তর পাগলামো এবং নির্বুদ্ধিতা নিয়ে কথা বলছে টুনি তখন উঠে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এলো। ছক্কাটা তার পকেটেই আছে কিন্তু কেউ যেন কিছু সন্দেহ না করে সে জন্যে উঠে গিয়ে ছক্কাটা আনার ভাণ করতে হল।
টুনি ছক্কাটা বোর্ডের উপর রেখে বলল, “নে মুনিয়া খেল।”
মুনিয়া খেলার আগে মিশু ছক্কাটা হাতে নেয় এবং ঘুরিয়ে দেখে হঠাৎ করে তার মুখটা জানি কেমন হয়ে যায়। এই ছক্কাটা আগের ছক্কা থেকে একটু বড়, দেখতেও ভিন্ন। কাজেই সে আর হাত সাফাই করে নিজের দুই নম্বরী ছক্কা দিয়ে বদলে দিতে পারবে না! বদলে দিলেই সবাই ধরে ফেলবে। মিশু ছক্কাটা নিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে মিশু ভাইয়া।”
মিশু বলল, “না, মানে ইয়ে—না— মানে কিছু বলব না।”
টুনি মুনিয়াকে বলল, “মুনিয়া খেল।”
মুনিয়া ছক্কাটা ফেলার আগে টুনি তাকে থামাল, বলল, “মুনিয়া এক সেকেন্ড দাড়া। তোকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেই।”
“মন্ত্র?”
“হ্যাঁ। লুডো খেলার মন্ত্র। এই মন্ত্র পড়লে ছয় উঠে।”
“যাহ্!” মুনিয়া অবিশ্বাসের শব্দ করল, বলল, “ছয় ফেলার মন্ত্র আবার আছে নাকী?”
“আছে। তুই চেষ্টা করে দেখ। আসল সোলেমানী যাদু বই থেকে শিখেছি।”
মুনিয়া এবারে মনে হয় একটু বিশ্বাস করল। জিজ্ঞেস করল, “কী মন্ত্র?”
টুনি বলল, “ছক্কাটা ফেলার আগে বলবি—
পাঁচ ঘষে ছয়— দুই নম্বরী ছক্কা
তুমি ভাবো বুদ্ধি বেশী
আসলে তো ফক্কা!”
মুনিয়া একটু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “এইটা মন্ত্র?”
“হ্যাঁ। এইটা মন্ত্র আমার সাথে বল—”
মুনিয়া টুনির সাথে মন্ত্রটা বলল এবং ছক্কাটা ফেলল, সবাই দেখল ছক্কাটা বোর্ডের উপরে গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে থেমে গিয়ে একটা ডিগবাজী দিয়ে ছয় হয়ে গেল। দর্শকদের ভেতর থেকে বিশাল একটা আনন্দধ্বনী শোনা গেল।
টুনি আড়চোখে মিশুর দিকে তাকাল, দেখলো মিশুর চেহারাটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে একবারও সন্দেহ করেনি এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তার চালাকীটা ধরতে পারবে। শুধু যে ধরে ফেলেছে তা নয় সেটা নিয়ে কবিতা বানিয়ে তাকে টিটকারী করছে। কী সর্বনাশ!
মুনিয়া আবার ছক্কা ফেলার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে টুনিকে আবার মন্ত্রটা উচ্চারণ করতে হল, মুনিয়া আবার টুনির সাথে সাথে মন্ত্রটা উচ্চারণ করল এবং ছক্কা ফেলল। ছক্কাটা আবার গড়িয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে কেমন জানি ব্রেক করে একটা লাফ দিয়ে ছয় হয়ে গেল। আবার বিশাল আনন্দধ্বনী, শুধু মিশু ছক্কার এই বিচিত্র আবরণ দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
তৃতীয়বার ছক্কা খেলার সময় টুনি তার চুম্বকটা সরিয়ে রাখল, এবারে একটা চার উঠল। মুনিয়া তার দুটো গুটি তুলে একটা চার চেলে ছক্কাটা মিশুর দিকে এগিয়ে দিল।
মিশু আড়চোখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে ছক্কাটা ফেলল, ছক্কাটা গড়িয়ে যায় এবং সত্যি সত্যি একটা ছয় উঠে গেল। দর্শক এবারে একটু থিতিয়ে যায়। টুনি মুনিয়াকে বলল, “তুই আবার মিশু ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে মন্ত্রটা বল, দেখি কাজ করে কী না।”
মুনিয়া মিশুর দিকে আঙ্গুল নেড়ে নেড়ে বলল,
“পাঁচ ঘষে ছয়, দুই নম্বরী ছক্কা
তুমি ভাবো বুদ্ধি বেশি
আসলে তো ফক্কা!”
মুনিয়ার মন্ত্রে কাজ হলো। দেখা গেল পরপর আরো দুটি ছয় উঠে তিন ছক্কার কারনে সব বাতিল হয়ে গেলো। চতুর্থবার যখন খেলেছে তখন ছক্কাটা শুধু যে বিচিত্র ভাবে লাফ দিয়ে ডিগবাজী খেয়ে যে এক হয়ে গেল তা নয়, সেই অবস্থায় একটু ঘুরপাকও খেল। কাজেই মিশুর কপালে জুটেছে মাত্র এক।
সবাই আনন্দধ্বনী করল এবং আনন্দধ্বনী থামার পর মিশু শুকনো গলায় বলল, “কিছু একটা গোলমাল আছে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী গোলমাল মিশু ভাই?”
“ছক্কাটা ঠিকভাবে পড়ছে না। কেমন যেন—”
“কেমন যেন কী?”
মিশু বাক্যটা শেষ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল, “না, কিছু না। ”
এতোক্ষণে মন্ত্রটা অন্য সবাই শিখে গেছে কাজেই প্রতিবার দান চালার সময় সবাই সমস্বরে চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে লাগল এবং প্রতিবার মুনিয়ার কমপক্ষে একটা করে ছয় উঠতে লাগল। শুধু তাই না মন্ত্রটা মিশুর বিরুদ্ধে কাজ করছে তাই প্রত্যেকবার তার এক উঠতে লাগল।
মিশুকে প্রথমে একটু হতবাক, তারপরে বিষণ্ণ, শেষে রীতিমত অসুস্থ দেখাতে লাগল। সে যেহেতু বুদ্ধিমান তাই কিছুক্ষণের মাঝেই কী হচ্ছে বুঝে গেল। কিন্তু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল না। একবার খুবই দুর্বলভাবে বলল, “ইয়ে-মানে-একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ! আমার উঠছে শুধু এক আর মুনিয়ার উঠছে শুধু ছয়। এটা খুবই বিচিত্র। প্রোবাবিলিটির নিয়ম অনুযায়ী এটা সম্ভব না।”
টুনি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ মিশু ভাইয়া। এইবারের টুর্নামেন্ট সবই আজব। আমি লক্ষ্য করছিলাম তুমি যখন খেলছিলে একবারও পাঁচ উঠে নাই। এইটা কী সম্ভব?”
মিশু আমতা আমতা করে বলল, “পাঁচ? মানে পাঁ পা পাঁচ?”
“হ্যাঁ। প্রোবাবিলিটির নিয়ম কী বলে মিশু ভাইয়া? পাঁচ না উঠে তার বদল ছয় ওঠার প্রোবালিটি কী সমান নাকী বেশী?”
উপস্থিত দর্শকেরা অবশ্যি টুনি এবং মিশুর এই আলাপে কোনো কৌতুহল দেখালো না। তারা মন্ত্র এবং মন্ত্রের ফলাফল দেখেই খুশি, এরকম আসলেই হওয়া সম্ভব কি না সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই মিশু খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। এবং দেখা গেল মুনিয়া যখন তার সবগুলো গুটি পাকিয়ে ফেলল তখনো তার সবগুলো গুটি ঘরের মাঝে আটকা পড়ে আছে লুডো খেলার ইতিহাসে এরকম হৃদয় বিদারক ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না।!
নিয়ম অনুযায়ী পরপর দুইবার খেলায় জিততে হবে। কিন্তু প্রথমবার হারার পরই মিশু পরাজয় স্বীকার করে নিল। সে আর খেলতে চাইল না।

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আবার দাদীকে প্রধান অতিথি হিসেবে ধরে আনা হল। দাদীর সাথে ঝুমু খালাও চলে এসেছে। দুইটা চেয়ারে দুইজনকে বসানো হয়েছে। ঝুমু খালা দাদীর পাশে চেয়ারে বসতে রাজী হচ্ছিল না তখন দাদী তাকে একটা ধমক দিল, বলল, “দেখছ না বাচ্চারা একটা অনুষ্ঠান করছে তুমি তার মাঝে ঝামেলা করছ। যা বলছে শুনো।”
ঝুমুখালা তখন কাচুমাচু হয়ে দাদীর পাশে বসল। সবাই তখন বক্তৃতা দিল, দাদী বক্তৃতা দেয়ার সময় বলল, “দিন রাত খালি খেললে হবে না, লেখাপড়াও করতে হবে। এই দেখিস না মিশু লেখাপড়া করে কতো বড় হয়েছে—”
টুনি তখন হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদী একজন যদি লেখাপড়া করে চোর হয় সেইটা ঠিক আছে?”
দাদী বলল, “ধুর! সেইটা ঠিক হবে কেন? লেখাপড়া করে চোর হবে কেন?
“যদি হয়?”
“না, না। ছিঃ।” দাদী জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বলল, “লেখপড়া করে কেউ যেন চোর না হয়।”
বক্তৃতা পর্ব শেষ হবার পর প্রথমে মিশুকে রানার আপের পুরস্কার হিসেবে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হল। সার্টিফিকেটের এক কোনায় লাল কলম দিয়ে কে যেন লুডো খেলার মন্ত্রটা লিখে রেখেছে। সেটা দেখে মিশুর কান পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল।
মিশুর পর মুনিয়াকে তার পুরস্কারের একশ টাকা তুলে দেয়া হল। দর্শকদের চিৎকারে ঘর ফেটে যাবার অবস্থা।
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “মুনিয়া তুই এতো টাকা দিয়ে কী করবি? আমাকে অর্ধেক দিয়ে দে।”
“না দিব না।” মুনিয়া মাথা নেড়ে বলল, “আমার লাগবে।”
“কেন লাগবে?”
“বলব না।”
শান্ত বলল, “বল। শুনি।”
”উহু বলব না।”
টুম্পা বলল, “আমি জানি। বলব?”
মুনিয়া গলা উচিয়ে বলল, “না। তুমি বলতে পারবে না আপু। ভালো হবে না কিন্তু।”
কাজেই টুম্পা সেটা বলতে পারল না। বলতে না পারলেও কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ কারণটা কীভাবে কীভাবে জানি সবাই জেনে গেছে। তাদের বাসার সামনের রাস্তাটি প্রতিদিন ভোরে একজন মহিলা ঝাট দেয়। তার ছোট একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চাটাকে পথের ধারে বসিয়ে রাখে। ধূলাবালির মাঝে নোংরা একটা শার্ট পরে সে বসে বসে চারিদিকে তাকায়, হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে। পথ থেকে নোংরা, ময়লা, সিগারেটের বাট তুলে মুখে দিয়ে দেয়। বাচ্চাটার জন্য মুনিয়ার খুব মায়া হচ্ছে। স্কুলে যাবার সময় তাকে পেলে মুনিয়া তার সাথে কথাবার্তা বলে। বাচ্চাটা ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে তাকিয়ে মাঝেমাঝে ফিক করে হেসে দেয়। মুনিয়া এই বাচ্চার জন্য একটা সুন্দর জামা কিনতে চায়— খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে জন্যে একশ টাকার মত লাগবে। সেই জন্যেই তার টাকাটার দরকার!
মিশুর আরো কয়েকদিন থাকার কথা ছিল কিন্তু সেইদিন বিকালেই সে চলে গেল। শান্ত তাকে রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। লুডো খেলার সময় আসলে কী কী ঘটেছে সেটা এতোক্ষনে সবার কাছে জানাজানি হয়ে গেছে।
মিশুকে বিদায় দেবার আগে শান্ত বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া, তুমি বলেছিলে না বেশী ভালো মানুষ হয়ে লাভ নাই? মাঝে মাঝে দুই নম্বুরী হতে হয়? বলেছিলে না?”
মিশু কথা না বলে চুপ করে রইল। শান্ত বলল, “কথাটা ঠিক না। দুই নম্বুরী হওয়া খুবই ডেঞ্জারাস।”
মিশু এবারেও কথা বলল না, মুখটা শুধু আরেকটু শক্ত হয়ে গেল। শান্ত বলল, “তোমার মাথায় যেরকম বুদ্ধি, আমাদের টুনির মাথাতেও সেরকম অনেক বুদ্ধি! একেবারে চিকন বুদ্ধি। তোমার থেকে বেশি। তুমি দুই নম্বুরী কাজ করেছ দেখে তোমাকে টাইট করে ছেড়ে দিয়েছে। দিয়েছে কী না?”
মিশু হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বলল না। শান্ত দার্শনিকের মত বলল, “বুঝলে মিশু ভাইয়া। দুই নম্বুরী মানুষ হওয়া ঠিক না! ধরা পড়লে মাইর খাওয়ার চান্স থাকে। মাইর মানে মাইর— উথাল পাতাল মাইর। অস্থির মাইর! বেইজ্জ্বতির চূড়ান্ত। বেইজ্জ্বতি বলে বেইজ্জ্বতি…..।”
শান্তর কথা শেষ হওয়ার আগেই মিশু প্রায় লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে গেল!

গো-গো-গোল্ডেন ফাইভ

গো-গো-গোল্ডেন ফাইভ


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বসার ঘরে দাদী (কিংবা নানী) টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখছেন, বড়দের কেউ কেউ খবরের কাগজ পড়ছে কেউ কেউ ঝুমু খালার তৈরি পায়েশের মত চা খাচ্ছে, ছোটরা মেঝেতে উবু হয়ে বসে রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলছে- তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চাদের একজন মাথা তুলে বলল, “তুমি আজকে কিছু আন নাই?”
ছোটাচ্চু বলল, “কী আনব?”
“এই তো, চকলেট না হলে আইসক্রিম না হলে কেক-”
আরেকজন বলল, “না হলে পিৎজা না হলে ফ্রায়েড চিকেন-”
আরেকজন বলল, “না হলে কাচ্চি বিরিয়ানী, না হলে জালী কাবাব-”
আরেকজন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ছোটাচ্চু তখন ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, “চুপ কর দেখি। তোদের হয়েছেটা কী? সারাক্ষণ শুধু খাই খাই করিস? মাত্র কালকেই এতো বড় একটা চকলেট কেক আনলাম-”
শান্ত বলল, “মোটেই এতো বড় না ছোটাচ্চু, আমি মাত্র চার স্লাইস খেয়েছি!”
একজন চোখ কপালে তুলে বলল, “চার স্লাইস!”
তখন বাচ্চারা কে বেশী স্লাইস খেয়েছে কে কম স্লাইস খেয়েছে সেটা নিয়ে নিজেরা নিজেরা ঝগড়াঝাটি করতে লাগল। ছোটাচ্চু একটা চেয়ার টেনে দাদীর পাশে বসে অন্যমনস্ক ভাবে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রইল। বোঝা যাচ্ছিল ছোটাচ্চু টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সেখানে কী দেখাচ্ছে সেটা দেখছে না। কিছু একটা চিন্তা করছে।
ছোটাচ্চু হঠাৎ করে মাথা তুলে টুনির দিকে তাকিলে বলল, “এই টুনি।”
রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা খেলায় টুনি এই মাত্র সেক্টর কমান্ডার হয়েছে, কাজেই সে অন্য কমান্ডারদের কাকে কী করতে অর্ডার দিবে চিন্তা করতে করতে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল।
ছোটাচ্চু বলল, “তুই আমার সাথে একটু দেখা করবি। আমার ঘরে।”
কথাটা এমন কিছু ভয়ানক কথা নয়, কিন্তু কী হল কে জানে হঠাৎ করে সব বাচ্চা খেলা বন্ধ করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। শুধু যে তাকাল তা নয় কঠিন চোখে আগুন ছড়িয়ে তাকাল।
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “কী হয়েছে? তোরা এভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন?”
একজন বলল, “তুমি শুধু টুনির সাথে কথা বলতে চাও কেন?”
আরেকজন বলল, “আমাদের পছন্দ হয় না?”
আরেকজন বলল, “তুমি টুনিকে যেটা বলতে চাও সেইটা আমাদেরকেও বলতে হবে।”
সবাই তখন একসাথে চিৎকার করে বলল, “বলতেই হবে। বলতেই হবে।”
ঠিক তখন টেলিভিশনে একজন সাজুগুজু করে থাকা মহিলা খুবই কাঁদো কাঁদো গলায় আরেকজন ত্যালতেলে চেহারার মানুষকে কিছু একটা বলছিল বাচ্চাদের চিৎকারের জন্যে দাদী সেটা শুনতে পেলেন না। দাদী (কিংবা নানী) খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই! তোরা চিৎকার থামাবি? তোদের জ্বালায় শান্তিমত একটা নাটক পর্যন্ত দেখতে পারি না।”
বাচ্চারা হয় দাদীর কথা শুনল না কিংবা শুনলেও তাঁর কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না। আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “বলতে হবে! আমাদের সবাইকে বলতে হবে। এক্ষুনি বলতে হবে।”
দাদী আরো গলা উচিয়ে বললেন, “ভাগ এখান থেকে। দূর হ সবগুলো।”
সবাই তখন উঠে ছোটাচ্চুকে ধরে রীতিমত টেনে টেনে তার ঘরে নিয়ে যেতে শুরু করল। শুধু টুনি সেই টানাটানিতে যোগ দিল না। সবার পিছনে পিছনে শান্ত মুখে হেঁটে হেঁটে ছোটাচ্চুর ঘরে গেল।
ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে বাচ্চারা ছোটাচ্চুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে তার চেয়ারে বসিয়ে তাকে ঘিরে দাড়িয়ে বলল, “বল এখন, তুমি টুনিকে কী বলতে চাইছিলে। বল।”
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আরে! তোরা কী পাগল হয়ে গেলি নাকি? সব কথা সবাইকে বলতে হবে? আমি কী আলাদা করে টুনির সাথে একটু কথা বলতে পারব না?”
সবাই চিৎকার করে বলল, “না, পারবে না।”
“কী মুশকিল! তোদের যন্ত্রনায় আমাকে পাগল হয়ে যেতে হবে।”
একজন বলল, “তোমাকে পাগল হতে হবে না ছোটাচ্চু, তুমি আগে থেকে পাগল।”
ছোটাচ্চু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন টুনি এগিয়ে এসে বলল, “ছোটাচ্চু-”
বাচ্চারা টুনির কথা শোনার জন্যে চেচামেচি থামিয়ে চুপ করল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর সি.ই.ও. হতে পার কিন্তু তোমার মাথায় বুদ্ধি খুব বেশী নাই।”
ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে বলল, “কী বললি তুই?”
“তুমি যদি শুধু আমার সাথে কথা বলতে চাও তাহলে সেটা গোপনে শুধু আমাকে বলতে হবে। সবার সামনে বললে হবে না। এখন দেরী হয়ে গেছে, সবাই জেনে গেছে, এখন যেটা বলতে চাও সেটা তোমাকে সবার সামনেই বলতে হবে। বল, কী বলতে চাও।”
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “যা ভাগ এখান থেকে। আমার কাউকেই আর কিছু বলতে হবে না।”
টুনি শান্ত গলায় বলল, “বলে ফেলো ছোটাচ্চু। এই বাসায় কোনো কিছু গোপন নাই, আমরা সবাই সবার সব কিছু জানি।”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ গজ গজ করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, বলছি।”
সবাই আরেকটু এগিয়ে এসে ছোটাচ্চুকে ঘিরে দাড়াল। ছোটাচ্চু একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফারিয়া একটা প্রজেক্ট করছে, সেটা ছেলে মেয়েদের বিজ্ঞান এবং গণিত-ভীতি নিয়ে। ফারিয়া সেজন্যে কয়েকটা স্কুলে একটা জরীপ চালাতে চায় সেই জন্যে বলেছে টুনির সাথে একটু কথা বলবে।”
বাচ্চারা ছোটাচ্চুর কথা শুনে খুবই হতাশ হলো, একজন বলল, “এই কথা? এই রকম ফালতু একটা কথা বলার জন্যে তুমি এরকম ঢং করেছিল? ছোটাচ্চু, টুনি ঠিকই বলেছে তোমার মাথায় কোনো বুদ্ধি নাই।”
আরেকজন বলল, “আয় যাই। রাজাকারের খেলাটা শেষ করি।”
শুধু টুনি বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু। তুমি ফারিয়াপুর সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিও। আমি ফারিয়াপুকে আমাদের স্কুলে নিয়ে যাবো।”
ছোটাচ্চু শুকনো মুখে বলল, “ঠিক আছে।”
বাচ্চারা সবাই তখন বসার ঘরে ফিরে গেলো রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা খেলার জন্যে। চিৎকার চেচামেচি হই চইয়ের মাঝখানে একসময় যে টুনি খেলা থেকে উঠে এলো সেটা কেউ লক্ষ্য করল না।

ছোটাচ্চুর ঘরের দরজা খুলে টুনি ভিতরে ঢুকে ছোটাচ্চুর বিছানায় বসে বলল, “বল ছোটাচ্চু, তুমি আমাকে আসলে কী বলতে চাইছিলে এখন বল।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল,“তুই কেমন করে বুঝলি?”
“না বোঝার কী আছে? তুমি এখনো মিথ্যা কথা বলা শিখো নাই। তুমি যখন মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করো তোমার নাকটা একটু মোটা হয়ে যায়, ঠোট কাঁপে আর বাম চোখটা ছোট হয়ে যায়।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “না-না-নাক মোটা হয়ে যায়?”
টুনি বলল, “এখন সেগুলো চিন্তা করে লাভ নাই ছোটাচ্চু, যেটা বলতে চাও সেটা বলে ফেলো। একটু পরে অন্যেরা চলে আসবে। অন্য সবাই চলে আসলে তুমি তোমার কথা থামিয়ে দিও। তখন আমি ফারিয়াপুর প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলব আসলে কী নিয়ে কথা হচ্ছে কেউ টের পাবে না।”
ছোটাচ্চু আরো কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা চুলকালো, তারপর বগল চুলকালো, তারপর গলা পরিষ্কার করে তাকে একটা কাহিনী বলল। কাহিনীটা এরকম :

ছোটাচ্চু তার অফিসে বসে কাজ করছে তখন তাদের অফিসের সেক্রেটারী রঞ্জনা এসে জানাল একজন মহিলা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। ছোটাচ্চু বলল, মহিলাকে পাঠিয়ে দিতে।
একটু পরেই মহিলা ছোটাচ্চুর অফিসে ঢুকল, মোটা সোটা নাদুস নুদুস মহিলা। ফর্সা, ঠোটে লিপস্টিক, বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের ভেতর। সব সময় ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে ভুরুর উপর পাকাপাকি ভাবে ভাঁজ হয়ে গেছে। দেখেই মনে হয় দুনিয়ার সবার উপরে খুবই বিরক্ত।
ছোটাচ্চু মহিলাকে তার সামনের চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল, “বলেন ম্যাডাম আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?”
মহিলা খুবই সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি ডিটেকটিভ?”
ছোটাচ্চু বলল, “আমি একা না, আমাদের একটা বড় টিম আছে।”
“আপনার বয়স এতো কম আপনি কী করবেন?”
ছোটাচ্চু বিরক্তি চেপে বলল, “বয়সটা তো ইস্যু না। আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারি কী না সেটা হচ্ছেু ইস্যু! আমরা একটা রেজিস্টার্ড প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন, আপনার যদি আমাদের পছন্দ না হয় আপনি আমাদের কাছে আসবেন না, অন্য কোথায় যাবেন!”
“আর তো কেউ নাই আপনারা ছাড়া।”
ছোটাচ্চু জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বলল, “তা ছাড়া আমরা যে সব কেস নিই তাও তো নয়। পছন্দ না হলে আমরা কেস নিই না।”
মহিলা তার কুচকানো ভুরু আরো কুচকে বলল, “আমার কেসটা আপনারা নিবেন না?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, আমি সেটা বলিনি। আমি তো আপনার কেসটা এখনো জানিই না। বলেন আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি।”
মহিলা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনারা আমার মেয়েটাকে বাচাঁন।”
“কী হয়েছে আপনার মেয়ের?”
মহিলা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি জানি না। মনে হয় ড্রাগস!”
ছোটাচ্চু আঁতকে উঠল, বলল, “ড্রাগস! কত বড়ো মেয়ে আপনার?”
“ক্লাস সেভেনে পড়ে। তেরোতো পা দিয়েছে।”
“এতো ছোট মেয়ে ড্রাগস ধরেছে?”
“ধরেছে কী না জানি না, আমি সন্দেহ করছি।”
ছোটাচ্চু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি কেন সন্দেহ করছেন?”
“ড্রাগ এডিক্টের মতো ব্যবহার করে।”
“সেটা কী রকম?”
“কথা বলে না। একা একা থাকে। শুকিয়ে যাচ্ছে, কেনো কিছুতে মনোযোগ নেই। পড়ালেখা করতে চায় না। গত পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ হয় নাই।”
“গোল্ডেন ফাইভ?”
“হ্যাঁ”, মহিলা এবারে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঁদতে শুরু করল, বলল, “আপনি চিন্তা করতে পারেন, আমার মেয়ের পিছনে আমি এতো সময় দেই আর সেই মেয়ের গোল্ডেন ফাইভ হয় না? তার জন্যে কতগুলো প্রাইভেট টিচার আর কোচিং রেখেছি আপনি শুনতে চান?”
ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, মহিলা তখন বলতে শুরু করল, “সকালে ফৌজিয়া ম্যাডাম, দুপুরে তালুকদার স্যার তারপর প্যারগন কোচিং, রাত্রে বিল্লাহ স্যার-”
ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে বলল, “ক্লাশ সেভেনের একটা মেয়ের জন্যে এইটা একটু বেশি হয়ে গেল না?”
“বেশি?” মহিলা বেশ অবাক হলো, বলল, “অন্যরা কী করে শুনবেন?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “না, না, শুনতে চাই না।”
মহিলা বলল, “মেয়েটার গানের গলা ভালো সেই জন্যে আমি গানের স্কুলে নেই, অন্যরাতো তাও নেয় না, তাদের সবকিছু বন্ধ। মেয়েটা এখন গানও গাইতে চায় না। আমি ভেবেছিলাম টেলিভিশনে গানের কম্পিটিশনে দিব কিন্তু যদি প্র্যাকটিস না করে কেমন করে কম্পিটিশন করবে?”
ছোটাচ্চু চুপচাপ বসে রইল আর মহিলা টানা কথা বলে গেল। যখন দম নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ঠিক কী করতে হবে?”
“খোঁজ নিয়ে বের করবেন মেয়েটা আসলেই ড্রাগ নেয় কী না। নিলে কী ড্রাগ নেয় আর কার কাছ থেকে সেই ড্রাগ কিনে।”
ছোটাচ্চু মহিলার কথাবার্তা শুনে প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিল এই মহিলার কেসটা নিবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিতে রাজী হল। ক্লাশ সেভেনের একটা মেয়ে সত্যিই যদি ড্রাগ নেয়া শুরু করে তাহলে তাকে তো সাহায্য করা দরকার। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার মেয়ের নাম কী?”
“আইরিন। ভালো নাম মাহজাবিন বিনতে কায়েস।”
“মেয়ের ছবি আছে আপনার সাথে?”
“হ্যাঁ, নিয়ে এসেছি।” বলে ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিল। ছোটাচ্চু ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখল, ছবিতে ড্রাগ এডিক্ট হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। হাসিখুশী একটা মেয়ে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার হাজব্যান্ড কী করেন?”
“ব্যাংকে চাকরী করে।”
“আপনার হাজব্যান্ড কী জানেন আপনি আমাদের এজেন্সীতে এসেছেন?”
“না জানে না। আমার হাজব্যান্ড একেবারে অপদার্থ। সংসারের কোনো কাজ কর্মে নাই। মেয়েটাকে মানুষ করার সব দায়িত্ব আমার।”
ছোটাচ্চু ইতস্তত করে বলল, “আপনার হাজব্যান্ডকে ব্যাপারটা জানালে হতো না?”
মহিলা মাথা নাড়ল, বলল “উহুঁ, তাকে জানিয়ে লাভ নাই। যা করার আমাকেই করতে হবে।”
ছোটাচ্চু তখন একটা ফর্ম বের করে মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা ফিল-আপ করে অফিসে জমা দিয়ে যান।”
মহিলা ফর্ম ফিল-আপ করে কিছু এডভান্স টাকা জমা দিয়ে চলে গেল।

ছোটাচ্চু কাহিনীটা এতোটুকু বলে থেমে গেল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে?”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকে বলল, “আমাদের যে নূতন স্টাফ আছে তাদেরকে লাগিয়েছি। তারা আইরিনকে ছায়ার মত ফলো করেছে কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পায় নাই। মেয়েটা মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে রিকশায় এক কোচিং সেন্টার থেকে আরেক কোচিং সেন্টারে যায়। ড্রাগের কোনো ব্যাপার যদি থাকে সেটা হয় কোচিং সেন্টারের ভিতরে, না হয় প্রাইভেট টিউটরদের বাসায়। এখানেই আমরা আটকে যাচ্ছি, ভিতরে মেয়েটাকে ওয়াচ করতে পারছি না।”
টুনি সরু চোখে বলল, “সেই জন্যে আমাকে ডেকেছ?”
“হ্যাঁ।”
“আমাকে কী করতে হবে?”
“তুই ভিতরে গিয়ে মেয়েটাকে ওয়াচ করবি। কী করে না করে ওয়াচ করে আমাদের এসে বলবি।”
“আমি ভিতরে কেমন করে ঢুকব?”
“দরকার হলে আমি তোকে ঐ কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেব।”
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি? কোচিং সেন্টারে? কখনো না।”
“প্লীজ!” ছোট চাচ্চু মুখ কাচু মাচু করে বলল, “প্লীজ টুনি, প্লীজ, এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নাই।”
“তাই বলে আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হব? বড় হলে আমার ছেলেমেয়েদের সামনে আমি কেমন করে মুখ দেখাব? তারা যদি জানে তাদের মা কোচিং সেন্টারে গেছে তাহলে লজ্জার চোটে তারা আত্মহত্যা করে ফেলবে না?”
ছোটাচ্চু কয়েক সেকেন্ড হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “কিন্তু তুই তো আসলে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছিস নান”
ঠিক তখন কয়েকজন বাচ্চা ছোটাচ্চুর ঘরে এসে ঢুকল, ছোটাচ্চু সাথে সাথে কথা বন্ধ করে ফেলল। টুনি বলল, “না, আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছি না। কোচিং সেন্টারে ভর্তি না হয়ে আমি কিভাবে সেখানে ফারিয়াপুর জরীপ করব? আমাকে তো কোচিং সেন্টারে ঢুকতেই দিবে না।”
ছোটাচ্চু কী বলবে বুঝতে না পেরে অ্যাঁ অ্যাঁ ধরনের একটা শব্দ করল। টুনি বলল, “তুমি ফারিয়াপুকে বুঝিয়ে বল যাদের কোচিং সেন্টারে যেতে হয়েছে তাদের জরীপ নিয়ে লাভ নাই। তারা স্বাধীন ভাবে চিন্টা করতে পারে না। কাজেই আমরা যদি কোচিং সেন্টারে জরীপ না করি কোনো ক্ষতি হবে না। ফারিয়াপু তার চল্লিশ পাসের্ন্ট ডাটা এমনিতেই পেয়ে যাবে। তার সাথে বাকী ত্রিশ পার্সেন্ট যোগ করলে-”
বাচ্চারা এই ঘরে বসে এই রকম বিরক্তিকর কথার কচকচানি শুনতে রাজি হল না, তারা মুখ বিকৃত করে বের হয়ে গেল। টুনি আর ছোটাচ্চু তখন আবার আগের আলোচনায় ফিরে গেল, ছোটাচ্চু বলল, “তুই তো আর সত্যি সত্যি কোচিংয়ে ভর্তি হচ্ছিস না। তুই একটা মেয়েকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিস!”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “তাকে কী আছে ছোটাচ্চু, সবাই জানবে আমি কোচিং করি! কোচিংয়ের খাতায় আমার নাম লেখা হয়ে যাবে। ছিঃ!”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে, তোকে একটা ভূয়া নামে ভর্তি করে দেব। কোচিংয়ের খাতায় তাহলে তোর আসল উঠবে না।”
টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে চোখের চশমাটা ঠিক করে বলল, “ঠিক আছে তাহলে!”

পরদিন ছোটাচ্চুর সাথে টুনি বাসা থেকে বের হল, অনেক সকাল হওয়ায় বাচ্চাদের বেশীর ভাগ তখনো ঘুমে তাই তারা সেটা টের পেল। না। ছোটাচ্চু প্রথমে তাকে তার অফিসে নিয়ে আইরিনের ছবিগুলো দিল। ছবিগুলো ভালো করে দেখে টুনি তার ব্যাগের ভেতর সেগুলো ঢুকিয়ে নিল। ছোটাচ্চু তখন প্যারাগন কোচিং সেন্টারে ফোন করে একটু খোঁজ খবর নিয়ে টুনিসহ সেখানে রওনা হলো।
টুনি ভেবেছিল কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্যে তারা টুনির কাগজপত্র দেখতে চাইবে কিন্তু সেরকম কিছু হল না, মনে হলো কেউ টাকা দিতে রাজী হলেই তাকে তারা ভর্তি করে নেয়। আই ডি কার্ড বানানোর জন্যে একটা ফটো চাইল, টুনি বলল, পরদিন নিয়ে আসবে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারে টুনির নাম হল তানিয়া জাহান, সংক্ষেপে তানিয়া।
টুনিকে কোচিং সেন্টারে ঢুকিয়ে ছোটাচ্চু চলে গেল, টুনি তখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো। এই প্রথম সে একটা কোচিং সেন্টারে এসেছে। সে জীবনেও চিন্তা করেনি যে সে এরকম একটা জায়গায় আসবে। এক সাথে অনেকগুলো ঘরে ব্যাচে ব্যাচে কোচিং হয়। টুনি খোঁজ খবর নিয়ে ক্লাশ সেভেনের ঘরটাতে ঢুকল। সাড়ি সাড়ি প্লাস্টিকের চেয়ার, সামনে একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপর কলম দিয়ে এবং মার্কার দিয়ে কোচিংয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের নানারকম মন্তব্য লিখে গেছে, ছবি এঁকে গেছে। সেগুলো পড়ে পড়েই মনে হয় সময়টা পার করে দেয়া যাবে। ঘরের সামনের দেওয়ালে একটা হোয়াইট বোর্ড ঝুলানো, পিছনে একটা শেলফ, ময়লা বিবর্ণ গাইড বই দিয়ে ঠাসা, দেখেই মন খারাপ হয়ে যায়। ঘরের দেওয়াল ময়লা, কোনায় কোনায় মাকড়শার জাল। মেঝেতে চিপসের খালি প্যাকেট, বাদামের খোসা, নানা ধরনের লিফলেট, মনে হল আধখাওয়া সিগারেটের একটা টুকরাও আছে। তবে ঘরটার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে তার বোটকা গন্ধ।
টুনি মাঝামাঝি একটা জায়গায় বসে, এখান থেকে দরজাটার দিকে তাকিয়ে কে আসছে সে দেখতে পারবে। ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। বেশীরভাগই একজন আরেকজনকে চিনে, নিজেদের ভেতর কথা বার্তা বলছে। টুনি সরাসরি কারো দিকে তাকাচ্ছিল না কিন্তু খুবই মনোযোগ দিয়ে কে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করতে থাকে। বেশীরভাগ কথা বার্ত্তাই ফেসবুক, স্ট্যাটাস, লাইক এই সব নিয়ে। একটা দুইটা হিন্দী সিনেমার নাম শোনা গেল। স্কুলের স্যার ম্যাডামদের গালাগাল করাও মনে হলো এদের খুব প্রিয় একটা কাজ। টুনি যদিও আইরিন মেয়েটার ছবিগুলো খুব ভালোভাবে দেখে এসেছে কিন্তু যখন সামনা সামনি দেখবে তখন চিনতে পারবে কী না বুঝতে পারছিল না। চেনা মানুষের ছবি দেখে চেনা যায়,  অপরিচিত মানুষকে ছবি দেখে সেরকম চেনা যায় না।
কিন্তু আইরিন দরজা দিয়ে ঢোকা মাত্র সে তাকে চিনতে পারল। মেয়েটার চেহারার মাঝে এক ধরনের উদাসীনতা, মনে হয় নিজের দিকে সে নজর দেয় না। জামা কাপড় কেমন যেন অগোছালো। এলোমেলো চুল, চোখে চশমা। আইরিন ঢুকে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা পিছনে চলে গেল। সবার পিছনে এক কোনায় টেবিলে ব্যাগ রেখে সে এদিকে সেদিক তাকিয়ে দেখল। টুনি তখন আইরিনের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিল। এখন সোজাসুজি তাকানো ঠিক হবে না। টুনি ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করল, খাতার মাঝখানে একটা ছোট চারকোনা আয়না টেপ দিয়ে লাগিয়ে এনেছে, আয়নাটা মেজো চাচীর মেক আপের কমপ্যাক্ট থেকে নেয়া। গাড়ীর আয়নার মত কনভেক্স মিরর হলে আরো ভালোভাবে অনেকটুকু জায়গা দেখা যেতো, কিন্তু এখন এটা দিয়েই কাজ চলে যাবে, আইরিনের দিকে না তাকিয়েই সে আইরিনকে দেখতে পারবে। টুনি খাতাটা একটু নাড়া চাড়া করে আয়নার ভেতর দিয়ে আইরিনকে লক্ষ্য করতে থাকে। মেয়েটা এদিক সেদিক তাকিয়ে যখন নিশ্চিত হল কেউ তাকে লক্ষ্য করছে না, তখন সে পিছনের বইয়ের শেলফের কাছে গিয়ে গাদাগাদি করে রাখা ছেড়া ময়লা পুরনো গাইড বইগুলোর পিছনে হাত দেয়, মনে হয় সেখান থেকে সে কিছু একটা নেবে। কী হতে পারে সেটা? ড্রাগস?
ঠিক কী নেবে টুনি দেখতে পারল না কারণ ঠিক তখন তার পাশের মেয়েটি তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখ আয়না দিয়ে?”
টুনি তার খাতায় লাগানো আয়নাটা লুকানোর কোনো চেষ্টা করল না, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “আয়নায় মানুষ কী দেখে?”
“চেহারা?”
“হ্যাঁ।” টুনি এবারে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার ভাণ করে মেয়েটার দিকে তাকালো, বলল, “আমার আই শ্যাডোটা মুছে গিয়েছে, তাই না?”
মেয়েটা একবার টুনির দিকে তাকালো তারপর ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “তোমার এতো বড় চশমা, আই শ্যাডো দেখাই যায় না।”
“বড় হলে আমি কন্টাক্ট লেন্স পরব।”
“কন্টাক্ট লেন্স? চোখের ভিতরে যেটা পরে?”
“ভিতরে না, উপরে।”
“ঐ হল, একই কথা।” মেয়েটা কেমন জানি গা ঝাড়া দিয়ে বলল, “কন্টাক্ট লেন্সের কথা চিন্তা করলেই আমার গা শির শির করে।”
মেয়েটা হাসিখুশী টাইপের, কথা বলতে পছন্দ করে। কিন্তু টুনি আজকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে কারো সাথে বন্ধুত্ব করে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। তাই সে আলাপ বন্ধ করার জন্যে ব্যাগের ভেতর থেকে রং পেন্সিলের বাক্স থেকে কালো পেন্সিলটা বের করে সেটা দিয়ে নিজের চোখের নিচে আই লাইনারের দাগ দেয়ার ভাণ করল, তারপর আয়নটা ঘুরিয়ে সে আবার আইরিনের দিকে তাকালো, মেয়েটি ডেস্কে মাথা ঝুকিয়ে কিছু একটা পড়ছে। শেলফের পিছন থেকে কী নিয়েছে জানা গেল না।
ঠিক তখন, কোথায় জানি এলার্মের মত একটা কর্কশ শব্দ হল। ক্লাশের ছেলেমেয়েরা তখন একটু নড়েচড়ে বসল আর প্রায় সাথে সাথে দরজা দিয়ে কোচিংয়ের টিচার এসে ঢুকল- মনে হল মানুষটা বুঝি দরজার পাশেই এলার্মের শব্দের জন্যে ঘাপটি মেরে বসেছিল! কমবয়সী চালবাজ ধরনের একজন মানুষ, তার হাতে ফটোকপি করা অনেকগুলো কাগজ। সে কাগজগুলো টেবিলের উপর রেখে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালো, এতোগুলো ছেলেমেয়ে দেখে তার মুখে একটা আনন্দের হাসি ফুটে উঠে। গলা পরিস্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের স্বাগতম। সবাইকে লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।” মানুষটা ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না। প্যারগনকে বলেছে ফ্যারাগন, গোলাপকে বলেছে গোলাফ! কী বিচিত্র!
ঘরটা ছোট, হাঁটাহাটি করার জায়গা নাই তার মাঝেই মানুষটা খুব কায়দা করে পায়চারী করার ভাণ করে থেমে গিয়ে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বল।”
টুনির ইচ্ছে হল বলে যে আপনারা প্যারাগনকে বলেন ফ্যারাগন! কিন্তু আসলেই তো আর সেটা বলা যায় না তাই সে চুপ করে রইল, অন্যেরাও বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, কিন্তু ঠিক কী বলল বোঝা গেল না। মানুষটা তখন নিজেই উত্তর দিল,বলল,“আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মডেল টেস্ট! আমরা একটার ফর একটা মডেল টেস্ট নেই যেন কোচিং সেন্টারের ছেলে মেয়েদের সব ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত হয়ে যায়।”
টুনির মুখটা নিশপিশ করতে লাগল বলার জন্যে যে শব্দটা ‘ফ্রশ্ন’ না, শব্দটা ‘প্রশ্ন’ কিন্তু এবারেও সেটা বলতে পারল না! মানুষটা টেবিলের উপর থেকে ফটোকপি করা একটা কাগজ তুলে দিয়ে সেটা উপরে তুলে সবাইকে দেখিয়ে বলল, “এই যে দেখো মডেল টেস্টের ফ্রশ্ন! তোমরা যদি এই ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে ফারো, তোমাদের গোল্ডেন পাইভ কেউ আটকাতে পারবে না।“

তোমরা যদি এই ফ্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে ফারো, তোমাদের গোল্ডেন পাইভ কেউ আটকাতে পারবে না

টুনি মনে মনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, মানুষটা শুধু যে প্রশ্নকে ফ্রশ্ন বলে তা নয়, ফাইভকে বলে পাইভ! কী ভয়ংকর!
মানুষটা হাতের কাগজটা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে আমরা সেটা গ্যারান্টি দেই। আমাদের গ্যারান্টি কঠিন গ্যারান্টি, গোল্ডেন না ফেলে টাকা পেরৎ!”
আবার ফেরৎকে বলেছে পেরৎ! মানুষটা চোখ বড় বড় করে ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে বসে থাকা সবার দিকে তাকাল, মনে মনে হয়তো আশা করেছিল সবাই বুঝি হাততালি দিবে! কিন্তু কেউ কিছু বলল না।
মানুষটা মুখ গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করল, “আমরা লেখাফড়া করি কী জন্যে?”
কেউ এবারেও কোনো কথা বলল না, সবাই মডেল টেস্ট দিতে এসেছে সেটা দিয়ে চলে যাবে কথাবার্তার মাঝে কারো উৎসাহ নেই। মানুষটা অবশ্যি হাল ছেড়ে দিল না, আবার জিজ্ঞেস করল, “বল, আমরা লেখাফড়া করি কী জন্যে?”
একজন খুবই অনিচ্ছার সাথে বলল, “শেখার জন্যে।”
মানুষটা মনে হল ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, মাথা ঝাকিয়ে বলল, “নো নো নো নো! শেখার জন্যে লেখাফড়া করে বোকারা! অনেক কিছু শিখে বোকার মত ঘরে বসে থাকে। বুদ্ধিমানরা লেখাফড়া করে ফরীক্ষায় নম্বর ফাওয়ার জন্যে। শুধু ফরীক্ষায় তারা গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায় না জীবনের সব জায়গায় গোল্ডেন এ ফ্লাস ফায়। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা বেতনের চাকরী করে। দেশে বিদেশে যায়। গাড়ী বাড়ী থাকে। ভালো ঘরে বিয়ে হয়।” (বিয়ের কথা শুনে এক দুইজন অবশ্যি ফিক করে হেসে দিল)
মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আর যারা শেখার জন্যে লেখাফড়া করে তাদের কী হয়? তারা স্কুল কলেজে চাকরী করে। মাসের শেষে কোনোবার বেতন ফায় কোনোবার বেতন ফায় না। ফ্রাইভেট টিউশনী করে।”
মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠল, “আপনার মত?”
সবাই তখন হি হি করে হেসে উঠে। মানুষটা রেগে উঠে বলল, “কে বলেছে? কে?”
কেউ উত্তর দিল না, শুধু হাসিটা কেমন জানি নিঃশব্দ একটা হাসিতে পাল্টে গেল। মানুষটার উৎসাহ হঠাৎ করে কেমন জানি একটু থিতিয়ে গেল, সে আর বক্তৃতা না বাড়িয়ে সবাইকে মডেল টেস্টের প্রশ্ন দিতে থাকে।
টুনি মাথা ঘুরিয়ে একবার আইরিনকে দেখল। ক্লাশে যে এতোকিছু হয়ে যাচ্ছে মনে হয় সে লক্ষ্যই করছে না। একমনে মাথা গুঁজে কিছু একটা পড়ে যাচ্ছে। মডেল টেস্টের প্রশ্নটা পেয়েও সে সেটা সরিয়ে রাখল, মনে হল উত্তর দেয়ার ইচ্ছাও নেই!
টুনি যদি মডেল টেস্টের উত্তর না দেয় কোনো ক্ষতি নেই, কিন্তু সে মোটামুটি মাথা খাটিয়ে মডেল টেস্টের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিছু সে জানে, সেগুলো নিয়ে সমস্যা নাই। যেগুলো জানে না সেগুলো সে লটারী করে ঠিক করল। অন্যদের শেষ করতে সময় লাগছে, টুনির মোটেই সময় লাগল না।
মডেল টেস্টের উত্তরগুলো নিয়ে মানুষটা সবাইকে সঠিক উত্তর লেখা একটা কাগজ দিয়ে মুখস্ত করতে লাগিয়ে দিল। কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার! সবাই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যখন উত্তর মুখস্ত করছে তখন টুনি আবার পিছনে বসা আইরিনকে তার খাতায় লাগানো আয়না দিয়ে লক্ষ্য করল, সে এখনো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, মুখস্ত করার দিকে তার কোনো আগ্রহ নেই।
শেষ পর্যন্ত আবার সেই কর্কশ এলার্মের মত শব্দ হল এবং সবাই তখন তাদের চেয়ার থেকে উঠে দাড়াল। টুনিও উঠে আইরিনকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু ভীড়ের মাঝে তাকে দেখা গেল না। টুনি একটু অপেক্ষা করে, যখন ভীড় কমে গেল তখন দেখল আইরিন নেই। আগেই চলে গেছে। টুনি পেছনের শেলফে পুরানো গাইড বইগুলোর পিছনে কিছু আছে কী না হাত দিয়ে দেখতে চাইছিল কিন্তু তার সুযোগ পেল না। দুইজন ছেলে সেখানে দাড়িয়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে এমন ভাবে কথা বলতে শুরু করল যে আর নড়ার লক্ষণ নেই। টুনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কিন্তু ততক্ষণে অন্য ক্লাশের ছেলে মেয়েরা ঢুকতে শুরু করেছে। টুনি বাধ্য হয়ে তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেট খুলে কোচিং সেন্টারের বাইরে এল। রাস্তার উল্টা পাশে ছোটাচ্চু দাড়িয়ে আছে। টুনি ডানে বামে তাকিয়ে রাস্তা পার হয়ে ছোটাচ্চুর কাছে যেতেই ছোটাচ্চু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু দেখলি?”
টুনি বলল, “সেরকম কিছু না। শুধু-”
“শুধু কী?”
“মেয়েটা ঘরটাতে ঢুকেই শেলফের বইয়ের পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা নিয়েছিল।”
ছোটাচ্চুর চোখ উজ্জল হয়ে উঠে, হাতে কিল দিলে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক লিড! কী নিয়েছে জানিস না?”
“উহুঁ, দেখতে পারি নাই।”
“সমস্যা নাই, কালকে দেখবি। একটু আগে আগে চলে যাবি।”
“ঠিক আছে। কিন্তু-”
“কিন্তু কী?”
টুনি বলল, “এই কোচিং সেন্টারে যদি আমাকে কয়েকদিন যেতে হয় তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। কালকেই শেষ।”
ছোটাচ্চু বলল,“যদি কালকের মাঝে কেস সলভ করতে পারিস তাহলে তো তোকে আর কোনোদিন যেতে হবে না।”
টুনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ ছোটাচ্চুর সাথে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ছোটাচ্চু বলল, “অফিসে চল, তোকে নানা ধরণের ড্রাগস চিনিয়ে দিই। কাল যদি কিছু একটা পেয়ে যাস তাহলে যেন চিনতে পারিস।”
টুনি বলল, “ঠিক আাছ।”
ছোটাচ্চু মুখটা দার্শনিকের মত করে বলল, “আমি বুঝতে পারি না, এই বয়সের বাচ্চারা কেমন করে ড্রাগস নেয়া শিখে যায়? কী সর্বনাশ!”
টুনি কোনো কথা বলল না।

পরদিন ছোটাচ্চু টুনিকে বেশ আগে প্যারাগন কোচিং সেন্টারে নামিয়ে দিয়ে গেল। টুনি ভেতর ঢুকে তাদের ক্লাসের জন্যে ঘরটায় গিয়ে দেখে সেখানে অন্য ক্লাসের ছেলে মেয়েরা বসে মডেল টেস্ট দিচ্ছে। একটু পরেই কর্কশ একটা শব্দ হল এবং ছেলেমেয়েরা তাদের খাতা জমা দিতে বের হতে শুরু করল। ছেলেমেয়েরা কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করতে করতে ধাক্কা ধাক্কি করতে করতে বের হচ্ছে, এই ফাঁকে টুনি ক্লাশের ভেতর ঢুকে ক্লাশের পিছনে শেলফের সামনে দাড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পুরানো ছেড়া বিবর্ণ গাইড বইগুলো দেখার ভাণ করতে থাকে। আইরিন নামের মেয়েটা শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সেখান থেকে কোনো একটা কিছু বের করে এনেছিল। টুনি একটা গাইড বই বের করার ভাণ করে পিছনে হাত দেয়। হাতে কিছু একটা লাগল, জিনিষটা ধরতেই বুঝে গেল একটা বই। টুনি বইটা বের করে আনে, বইটার নাম থ্রী কমরেডস বইয়ের লেখকের নাম এরিখ মারিয়া রেমার্ক!
কী আশ্চর্য! মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে আর সবাই সন্দেহ করছে সে ড্রাগস খায়! টুনি বইয়ের কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে দেখল,এই লেখকের আরো কয়েকটা বইয়ের নাম দেয়া আছে, একটা বইয়ের নাম, অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট! টুনি এই বইটার নাম শুনেছে, লেখক নিশ্চয়ই বড় লেখক। বইটা জার্মান ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করা, লেখক নিশ্চয়ই জার্মান। একেবারে তার বয়সী এই ছোট মেয়েটা এতো বড় বড় বই পড়ে আর তার মা ভাবছে সে বুঝি ড্রাগস খায়! কী আশ্চর্য! শুধু তাই না তাকে ধরার জন্যে মেয়েটির মা ডিটেকটিভ লাগিয়েছে আর টুনি কীনা ছোটাচ্চুর বুদ্ধি শুনে বই পড়া এই মেয়েটার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে। কী লজ্জা! কী লজ্জা! টুনির একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে করল।
টুনি এদিক সেদিক তাকিয়ে বইটা শেলফের পিছনে যেখানে পেয়েছিল সেখানেই রেখে দিল। তার কাজ শেষ এখন সে চলে যেতে পারে, ছোটাচ্চুকে বলতে পারে আইরিন নামে মেয়েটি মোটেও ড্রাগ খাওয়া মেয়ে নয়। মেয়েটি বই পড়তে ভালোবাসে, বাসায় যেহেতু বই পড়তে দেয় না তাই যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুকিয়ে লুকিয়ে বই পড়ে। কিন্তু ছোটাচ্চু এক ঘন্টা পর তাকে নিতে আসবে, আগে বের হয়ে গেলে তাকে না পেয়ে ছোটাচ্চু ঘ্যান ঘ্যান শুরু করবে। তাকে এখন অপেক্ষাই করতে হবে। শুধু যে অপেক্ষা করতে হবে তা নয় চালবাজ মানুষটার ভুল উচ্চারণে কথাবার্তা শুনতে হবে। কীভাবে ছেলেমেয়েগুলো এই ঘরটার মাঝে গাদাগাদি বসে দিনের পর দিন এরকম একজন মানুষের কথা শুনে?
টুনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে পড়ল। এক সময় ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করে। নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে ঘরটার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতে থাকে। এক সময় আইরিনও ঘরটাতে ঢুকলো। ঘরের পিছনে শেলফের সামনে গিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে শেলফের পিছনে হাত দিয়ে তার বইটা বের করে আনল। তারপর ঘরের একেবারে কোনার সিটটাতে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়তে শুরু করে। মনে হয় তার চারপাশে কী ঘটছে সে তা কিছুই শুনছে না- এখানে থেকেও সে এখানে নেই।

কিছুক্ষণ পর কর্কশ একটা এলার্মের মত শব্দ হল আর প্রায় সাথে সাথেই গতকালকের সেই চালবাজ মানুষটা এক গাদা কাগজপত্র নিয়ে হাজির হল। টেবিলের উপর কাগজপত্রগুলো রেখে সে ঘরের মাঝে গাদাগাদি করে বসে থাকা ছেলেমেয়ে গুলোর দিকে তাকাল, তারপর গলা পরিষ্কার করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে তোমাদের লাল গোলাফের শুভেচ্ছা।”
টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল যে মানুষের উচ্চারণ এতো খারাপ সে কেন মুখ খুলে?
মানুষটার অবশ্যি উচ্চারণ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই, দাঁত বের করে হেসে বলল, “আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য কী বল।”
কেউ কোনো কথা বলল না, মাছের মত চোখের পাতি না ফেলে সবাই মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা বলল, “আমাদের কোচিং সেন্টারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের মডেল টেস্ট। আমরা ফরতেক দিন মডেল টেস্ট নেই …”
টুনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল মানুষটা গতকাল যে কথাগুলো বলেছিল আজকেও সেই একই কথাগুলো বলছে! টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মত, একই কথা একইভাবে প্রত্যেকদিন সবাইকে শোনানো হয়। কী আশ্চর্য্য। কোচিং সেন্টারে না এলে টুনি জানতেই পারতো না এখানে কী হয়। টুনি মানুষটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ক্লাশের অন্যান্যদের লক্ষ্য করতে লাগল, কতো রকম ছেলে মেয়ে কতো আশ্চর্য্য তাদের মুখের ভঙ্গী। মানুষটা তার বিচিত্র উচ্চারণে টানা কথা বলে যেতে লাগলো, টুনি না শোনার চেষ্টা করে অন্যমনস্ক ভাবে বসে রইল।

“তানিয়া জাহান। তানিয়া-”
টুনি অন্যমনস্ক হয়ে ছিল বলে লক্ষ করেনি মানুষটা তাদের মডেল টেস্টের খাতাগুলো ফেরৎ দিচ্ছে। নাম ডাকা মাত্র সবাই তাদের খাতা নিচ্ছে কিন্তু তানিয়া জাহানের খাতাটি কেউ নিচ্ছে না এবং তখন টুনির মনে পড়ল এই কোচিং সেন্টারে তার নাম তানিয়া জাহান। সে হাত তুলে দাড়াল।
মানুষটা খাতা নিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “মডেল টেস্টের ফরীক্ষায় তোমার কী সমস্যা হয়েছে?’
টুনির ইচ্ছা হল বলে, শব্দটা ফরীক্ষা না, শব্দটা হচ্ছে পরীক্ষা। কিন্তু সেটা বলল না, বলল, “আমার কোনো সমস্যা নাই।”
“তাহলে মডেল টেস্ট এতো খারাফ করছ কেন? মাত্র চল্লিশ ফেয়েছ।”
টুনি বলল, “চল্লিশ অনেক নম্বর।”
মানুষটা প্রায় আর্তনাদের মত করে বলল, “ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে একশতে ফচানব্বই ফেলে ফাশ। তোমাদের সবকিছু মুখস্ত করতে দিয়েছি না? মুখস্ত করলা না কেন? লেখাফড়া মানেই মুখস্ত। মুখস্ত মানেই লেখাফড়া।”
টুনি ভাবল বলে শব্দটা লেখাফড়া না, শব্দটা লেখাপড়া এবং মুখস্ত মানেই লেখাপড়া কথাটা মোটেই সত্যি না। কিন্তু কিছু বলল না, একটু পরেই এখান থেকে চলে যাবে আর কোনোদিন আসতে হবে না, শুধু শুধু এখন কথাবার্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। টুনি হাসি হাসি মুখে চুপ করে দাড়িয়ে রইল।
মানুষটা দুই হাত নেড়ে প্রায় নাচার মত একটা ভঙ্গী করে বলল, “তোমরা অন্য কোচিং সেন্টারে যাও তারা তোমাদের উল্টাফাল্টা জিনিস মুখস্ত করতে দিবে। মুখস্ত করবে কিন্তু ফরীক্ষায় সেই জিনিস আসবে না। আমাদের ফ্যারাগন কোচিং সেন্টারে কখনো সেইটা হয় না। যেটা মুখস্ত করবা সেইটাই ফরীক্ষায় ফাবে। গ্যারান্টি।”
টুনি এবারে আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলল, “আংকেল, পরীক্ষায় কোনটা আসবে সেইটা আপনারা আগে থেকে কেমন করে জানেন?”
মানুষটা কেমন যেন একটু খাবি খেলো, তারপর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “সবাই আমারে স্যার ডাকে, তুমি আংকেল ডাকো, ব্যাফারটা কী?”
টুনি বলল, “কিন্তু আপনি তো আমার স্যার না। যারা পড়ায় তার স্যার। আপনি তো পড়ান না। আপনি মডেল টেস্ট নেন। মুখস্ত করার জন্যে কাগজ দেন। আপনি আংকেল।”
মানুষটা আরেকবার খাবি খেল। বলল, “আমি আংকেল?”
“হ্যাঁ।”দেখা গেল টুনির সাথে সাথে আরো অনেকে মাথা নেড়ে বলল, “আংকেল! আংকেল!”
মানুষটা এবারে কেমন জানি থতমত খেয়ে গেল। টুনি তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেমন করে আগে থেকে জানেন আমাদের পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে?”
মানষটা আস্তে আস্তে কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “তোমার এতো কিছু জানার দরকার কী? আমরা কোন জায়গা থেকে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন আনি সেইটা আমাদের ব্যাফার। তোমরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছ এখন চোখ বন্ধ করে আমাদের ফ্রশ্ন মুখস্ত করবে। বুঝেছ?”
টুনির কেমন জানি একটা জিদ চেপে গেল। সে ঠান্ডা গলায় বলল, “এক সেকেন্ড আংকেল।” তারপর ব্যাগের ভেতর থেকে তার একটু মোটা ধরণের বল পয়েন্ট কলম বের করে কলমটা অনেকটা মাইক্রোফোনের মত করে মানুষটার দিকে ধরে বলল, “আংকেল। এখন বলেন।”
‘আংকেল’ এবারে কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। একটু ভয়ে ভয়ে কলমটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা কী?”
“মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার। আপনি যেটা বলবেন সেইটা রেকর্ড হয়ে যাবে। বলেন আংকেল।”
মানুষটা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “বন্ধ কর। এইটা বন্ধ কর।”
টুনি মানুষটার কথা না শোনার ভাণ করে বলল, “আংকেল এখন আপনি বলেন, পরীক্ষার আগে সব প্রশ্ন আপনারা কেমন করে পেয়ে যান।”
মানুষটা হঠাৎ করে ঠোট চেপে মুখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর কেমন যেন ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে শুট করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথে ঘরের সব ছেলে মেয়ে টুনির দিকে তাকায়, প্রথমে কেউ কোনো কথা বলে না, তারপর হঠাৎ করে সবাই এক সাথে কথা বলতে শুরু করে। টুনি চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আইরিন পর্যন্ত তার বই পড়া বন্ধ করে টুনির দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছুক্ষনের ভেতরেই দরজা দিয়ে চালবাজ মানুষটা ফিরে এলো, এবারে সে একা না, তার সাথে আরো কয়েকজন আছে। একজন মোটাসোটা আরেকজন হালকা পাতলা আরেকজন টিশটাশ মহিলা। চালবাজ মানুষটা টুনিকে দেখিলে বলল, “এই মেয়েটা।”
মোটাসোটা মানুষটা বলল, “এই মেয়ে, তুমি আমাদের ইন্সট্রাক্টরদের কথা রেকর্ড করার চেষ্টা করছ কেন? তোমার ভয়েস রেকর্ডারটা আমাকে দাও।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উহুঁ। দিব না।” তারপর মোটা বল পয়েন্ট কলমটা উপরে তুলে মাইক্রোফোনের মত মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে ধরল। মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকালো, তখন টিশটাশ মহিলা বলল, “এই মেয়ে- তুমি নিজ থেকে যদি না দাও তাহলে আমাদের স্টাফ জোর করে তোমার কাছ থেকে এটা নিয়ে নেবে। তুমি আমাদের কোচিং সেন্টারে এসে আমাদের কথা বার্তা রেকডিং করতে পার না।”
টুনি বুঝতে পারল অবস্থাটা জটিল থেকে জটিল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু যেহেতু এটা শুরু হয়ে গেছে এখন থামার উপায় নাই। টুনি একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “আন্টি, এটা ঠিক হবে না।”
টিশটাশ মহিলা বলল, “এটা ঠিক হবে না?” তুমি কেন বলছ এটা ঠিক হবে না মেয়ে?”
চালবাজ মানুষটা বলল, “এর নাম। তানিয়া জাহান। তানিয়া।” টিশটাশ বলল, “কেন এটা ঠিক হবে না, তানিয়া?”
টুনি বলল, “আসলে এটা আমার আসল নাম না। এটা ছদ্ম নাম।”
মানুষগুলো একসাথে বলল, “ছদ্ম নাম?”
টুনি মাথা নড়ল, বলল, “আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সী থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে এখানে কী হয় সেটা ইনভেস্টিগেট করার জন্যে।”
সামনে দাড়ানো সবগুলো মানুষের চোয়াল এক সাথে ঝুলে পড়ল। মোটা সোটা মানুষটা কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কে-কে-কেন?”
“আমি জানি না। মনে হয় গভমেন্ট থেকে দায়িত্ব দিয়েছে।”
মানুষগুলোর চোয়াল এমনিতে ঝুলে ছিল আরো ঝুলে পড়ার কোনো উপায় নাই, তাই এবারে জিবগুলো একটু বের হয়ে এলো। হালকা পাতলা মানুষটা নাঁকি গলায় বলল, “গভমেন্ট?”
টুনি উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর একটা কার্ড বের করে মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই যে কার্ডে ফোন নম্বর আছে ফোন করে দেখতে পারেন। ওয়েবসাইটটাও চেক করতে পারেন।”
টিশটাশ মহিলা কার্ডটা নিল, সবাই কার্ডটা ঝুকে পড়ে দেখল, তারপর নিজেদের ভেতর গুজগুজ ফুসফুস করে নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। তারপর একজন কার্ডটা নিয়ে বের হয়ে গেল, কিছুক্ষণ পর মুখটা কালো করে ফিরে এসে মাথা নাড়ল। টুনি বুঝতে পারল ছোটাচ্চুর সাথে ফোনে কথা বলে এসেছে, কি হচ্ছে ছোটাচ্চু কিছুই বুঝতে পারেনি কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে টুনি এখানে আছে।
মানুষগুলো নিজেদের ভেতর আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর মোটাসোটা মানুষটা গলার মাঝে মধু ঢেলে বলল, “এই যে খুকি মনে হয় আমাদের মাঝে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আমাদের ইনস্ট্রাক্টর ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, সেটা কীভাবে বলেছেন আর তুমি সেটাকে কীভাবে নিয়েছ এটা নিয়ে মনে হয় একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। ”
টুনি হঠাৎ করে বুঝে গেল মানুষগুলো ভয় পেয়েছে। সে এখন ইচ্ছে করলে যা খুশী তাই বলতে পারবে, আরো ভয় দেখাতে পারবে। তাই কলমটা মাইক্রোফোনের মত নিজের মুখের কাছে ধরে বলল, “আংকেল এখানে সবাইকে বলেছেন আমাদের পরীক্ষায় কী আসবে সেটা মডেল টেস্ট করিয়ে আমাদের মুখস্ত করিয়ে দেবেন। একশভাগ গ্যারান্টি। আমি জানতে চেয়েছিলাম আংকেল আগে থেকে কেমন করে জানবেন কোনটা পরীক্ষায় আসবে! স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্ন তো গোপন।”
মোটাসোটা মানুষ চালবাজ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি এটা বলেছ?”
চালবাজ মানুষ খাবি খেয়ে বলল, “না মানে ইয়ে আমি শুধু বলেছি ফ্রত্যেক দিন আমরা মডেল টেস্ট নেই-”
যে কথাটা বলার জন্যে গত দুইদিন টুনির মুখটা নিশপিশ করছিল শেষ পর্যন্ত সেটা বলেই ফেলল, “আংকেল আপনি বলছেন ফরতেক, আসলে উচ্চারণটা হচ্ছে প্রত্যেক।”
কয়েক সেকেন্ড ঘরের মাঝে কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ একজন হাসি চাপতে না পেরে নাক দিয়ে বিদঘুটে একটা শব্দ করে ফেলল। হাসি খুবই সংক্রামক একটা ব্যাপার, তাই সেটা শুনে আরেকজন, তারপর আরেকজন তারপর ঘরের সবাই প্রথমে চাপা তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। চালবাজ মানুষটা প্রথমে লাল তারপর নীল তারপর বেগুনী হয়ে গেল, তারপর বেগুনীর মাঝে ছোপ ছোপ লাল আর নীল রং দেখা যেতে লাগল।
টুনি বুঝতে পারল সে এখন পর্যন্ত যেটুকু করেছে সেটা অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ছোটাচ্চু জানতে পারলে তার খবর হয়ে যাবে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। বড় কিছু অঘটন ঘটে যাবার আগে তার এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিৎ। টুনি তাই কিছুই হয়নি সেরকম একটা ভাব করে খুব ধীরে ধীরে তার ব্যাগের ভিতর তার খাতাপত্র ঢোকালো, তার মোটা কলমটা রাখল, তারপর ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু ঠিক কী বলবে কীভাবে বলবে বুঝতে না পেরে ইতি উতি করতে লাগল, খাবি খেতে লাগল।
টুনি ঘর থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে কোচিং সেন্টারের কুৎসিত বিল্ডিং থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এসে বুকের ভেতরে আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে দিল। কোচিং সেন্টারে এই মাত্র নাটকটা করে আসা ঠিক হলো কী না সে এখনো বুঝতে পারছে না।
রাস্তার পা দিয়ে সে মাত্র কয়েক পা হেঁটেছে তখন সে হঠাৎ শুনল পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে, “এই যে, এই যে শোনো-”
টুনি ঘুরে তাকালো, দেখল আইরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে হেঁটে আসছে। টুনি দাড়িয়ে গেল। আইরিন কাছে এসে বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ক্লাশটাতে ছিলাম, আমার নাম আইরিন।”
টুনি ভাবল বলে, আমি জানি! তোমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আমি এই কোচিং সেন্টারে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা বলল না। বলল, “আমার আসল নাম টুনি।”
“টুনি, তুমি আজকে কোচিং সেন্টারে যেটা করেছ সেটা এমনই আশ্চর্য ঘটনা যে আমি দেখে বেকুব হয়ে গেছি।”
টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “কাজটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না, মনে হয় বড় বড় মানুষদের সাথে বেয়াদপি করে ফেলেছি!”
“করলে করেছ। কিন্তু একেবারে সত্যি কথা বলেছ। তুমি আসলেই ডিটেকটিভ এজেন্সীর মেয়ে? ডিটেকটিভ এজেন্সীতে এতো ছোট মেয়ে কাজ করে? ”
টুনি ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “আমার ছোটাচ্চুর এজেন্সী। সেই জন্যে মাঝে মাঝে ছোটাচ্চুর জন্যে কাজ করে দেই। ছোটাচ্চু অবশ্যি খুবই বিরক্ত হয়। আজকে এখানে কী হয়েছে শুনলে মনে হয় আমাকে খুনই করে ফেলবে।”
আইরিন মেয়েটা হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসতে হাসতে কোনো মতে বলল, “ফরতেক-” তারপর আবার হাসতে শুরু করল, হাসি আর থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। হাসি নিশ্চয়ই খুবই ছোয়াচে একটা বিষয়, তাই আইরিনকে দেখে টুনিরও হাসি পেয়ে গেল এখন সেও একটু একটু করে হাসতে শুরু করল।
অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে আইরিন বলল, “কতোদিন পর আমি হাসলাম। হাসতে কেমন লাগে ভুলেই গিয়েছিলাম।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি হাসতে ভুলে গিয়েছ?”
আইরিন মাথা নাড়ল, বলল, “অনেক জটিল ব্যাপার তোমাকে বললেও তুমি বুঝবে না”
টুনি বলল, “ও।” তারপর চুপ করে গেল। একজনকে নিজে থেকে কথা বলতে দিতে হয়। মেয়েটা মনে হয় নিজে থেকেই বলবে তাই টুনি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
দুইজন পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল হঠাৎ করে আইরিন একটা দোকানের সামনে দাড়িয়ে গেল, বলল, “আইসক্রিম খাবে?”
টুনি মাথা নাড়ল, “খাব।”
আইরিন বলল, “টেনেটুনে আমার একটা আইসক্রিমের পয়সা হবে, দুইজনে ভাগাভাগি করে খেতে হবে।”
টুনির কাছে কিছু টাকা আছে ইচ্ছে করলে দুইজন মিলে দুইটা আইসক্রিম খেতে পারে কিন্তু টুনি কিছু বলল না। দুইজন মিলে একটা আইসিক্রম খেলে মেয়েটা তাড়াতাড়ি তার কাছে সহজ হবে, এক ধরণের বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।

দুইজন মিলে একটা আইসিক্রম খেলে মেয়েটা তাড়াতাড়ি তার কাছে সহজ হবে

টুনির ধারণা সত্যি, মেয়েটা একটুখানি খেয়ে টুনির হাতে আইসক্রিমটা দিয়ে বলল,“আমি যখন কোচিংয়ে আসি আম্মু আমাকে দরকার থেকে একটা পয়সা বেশি দেয় না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না।”
টুনি বলল, “তবু শুনি।”
“আমার আম্মুর ধারণা আমাকে দরকার থেকে বেশী টাকা দিলে আমি সেটা দিয়ে ড্রাগস কিনে খাব।”
কথা শুনে চমকে যাবার টুনি একটা অনবদ্য অভিনয় করল। আইরিন বলল, “আমার আম্মুর যন্ত্রণায় জীবন শেষ। জিপিএ ফাইভ ছাড়া আম্মু আর কিছু বুঝে না।”
টুনি বলল, “সত্যি?”
আইরিন বলল, “জিপিএ ফাইভ দিয়ে তোমার আম্মু তোমাকে জ্বালায় না?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ। আমি কোন ক্লাশে পড়ি আমার আব্বু আম্মু মনে হয় ভালো করে জানেও না।”
“সত্যি?’
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি।”
“তোমাকে প্রাইভেট পড়তে হয় না? কোচিং যেতে হয় না?”
টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমাদের বাসায় আমরা সবাই এক সাথে থাকি। কেউ প্রাইভেট পড়ে না, কোচিংয়ে যায় না। বাসার নিয়ম হচ্ছে নিজে পড়লে পড় না পড়লে নাই।”
আইরিন প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করল, “না পড়লে নাই?’
টুনি মাথা নাড়ল। আইরিন খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমার উপর কী ভয়ানক চাপ তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। আব্বু বেশী কিছু বলে না কিন্তু আম্মু আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। আমার গল্প বই পড়তে ভালো লাগে আমার আম্মু বাসা থেকে সব গল্প বই সরিয়ে দিয়েছে।”
“সত্যি?”
আইরিন মাথা নাড়ল। বলল,“সত্যি। আমার গল্প বই পড়তে এতো ভালো লাগে কিন্তু আমাকে পড়তে দেয় না। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। চুরি করে পড়ি।”
টুনি কোনো কথা বলল না। আইরিন বলল, “ভোর রাতে আম্মু ঘুম থেকে ডেকে তুলে, প্রথমে এক জায়গায় প্রাইভেট পড়তে পাঠায় সেখান থেকে আরেক জায়গায়। স্কুলের পর কোচিং, রাতে আবার প্রাইভেট। পরীক্ষার পর খুনের আসামীর মত আমাকে একটা একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে দেখে। আমার পড়ালেখা থেকে মন উঠে গিয়েছে, পড়তে ইচ্ছা করে না। পরীক্ষা দিতেও ভালো লাগে না। গত পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয় নাই তাই আম্মুর কী রাগ! পারলে আমাকে খুন করে ফেলে। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা উঠতে বসতে শুধু খোটা দিয়ে কথা।”
দুইজন কিছুক্ষন চুপচাপ হেঁটে যায়। তারপর আইরিন বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলে টুনি আামি কী ঠিক করেছি?”
“কী ঠিক করেছ?”
“চুল কেটে ছেলে সেজে সার্ট প্যান্ট পরে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাব।“
টুনি ভয়ানক চমকে উঠল, বলল, “পালিয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ, পালিয়ে যাব। একটা টেম্পুর হেল্পার হয়ে জীবন কাটিয়ে দিব। ভালো না আইডিয়াটা?”
টুনি মাথা চুলকালো, বলল, “ইয়ে মানে আমার মনে হয়-”
আইরিন বলল,“আমি এখনো কাউকে বলিনি আমার প্ল্যানটা। তোমাকেই প্রথমে বললাম।”
টুনি বলল,“থ্যাংকু।”
আইরিন অনেকটা নিজের মনে বলল, “আমি জানি কেউ যদি আমার প্ল্যানটা শুনে ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মাথা খারাপ হয় নাই। আমি যদি বাড়ী থেকে পালিয়ে না যাই তাহলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আম্মুর অত্যাচারে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবেই যাবে। খোদার কসম।”
টুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আইরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি জানো আমার আম্মু কী করেছে?”
“কী করেছে?”
“আমি ড্রাগ খাই কী না দেখার জন্যে আমার পিছনে লোক লাগিয়েছে। পারলে ডিটেকটিভ লাগিয়ে দেবে।”
টুনি খুব অস্বস্তির সাথে নিজের মাথা চুলকে এদিক সেদিক তাকালো। মেয়েটা যদি শুধু জানতে পারে তার মা ডিটেকটিভ সতি সত্যি লাগিয়ে দিয়েছে আর সে হচ্ছে সেই ডিটেকটিভ তাহলে মনে হয় মেয়েটা হার্টফেল করেই মরে যাবে!
দুজনে তখন হাটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে এসেছে, টুনি হঠাৎ দাড়িয়ে গেল, বলল,“চল আরেকটা আইসক্রিম খাই!”
“আরেকটা?”
“হ্যাঁ, আমার কাছে টেনেটুনে একটা আইসক্রিমের দাম হয়ে যাবে। আবার ভাগাভাগি করে খাব। আলাদা আলাদা খাওয়ার থেকে ভাগাভাগি করে খেতে বেশী মজা।”
আইরিন বলল, “ঠিকই বলেছ।”
তারপর তারা আরেকটা আইসক্রিম কিনে দুইজন ভাগাভাগি করে খেতে খেতে হাঁটতে থাকে। আইরিন বলল, “আমার পালিয়ে যাওয়ার প্লানটা কেমন মনে হচ্ছে?”
টুনি বলল, “মনে হয় ভালোই। তবে-”
“তবে কী?”
“এটা হোক প্ল্যান বি।”
“প্লান বি?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আগে প্ল্যান এ, কাজে লাগানো যাক। সেটা যদি কাজ না করে তখন প্ল্যান বি তে যাবে।”
“প্ল্যান এ তাহলে কী হবে?’
“তুমি একটু আগেই বলেছ।”
আইরিন বলল, “আমি বলেছি?”
টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, বলেছ।”
“কী বলেছি?”
“তুমি বলেছ তুমি যদি বাড়ী থেকে পালিয়ে না যাও তাহলে পাগল হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ বলেছি। আসলেই পাগল হয়ে যাব।”
টুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে পাগল হয়ে যাচ্ছ না কেন? পাগল হয়ে যাও।”
“পাগল হয়ে যাব?”
“হ্যাঁ। ভাণ করো পাগল হয়ে যাচ্ছ।”
আইরিন কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ করে বুঝতে পারল টুনি কী বলছে। তার চোখ দুটো প্রথমে বড় বড় হয়ে গেলো, সেখানে অবিশ্বাস তারপর হঠাৎ করে তার সারা মুখ হাসির দমকে কেঁপে উঠল। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে টুনির পিঠে একটা থাবা দিয়ে বলল, “হায় খোদা! তোমার মাথায় এতো দুষ্টু বুদ্ধি!”
টুনি বলল, “না, আইরিন এটা দুষ্টু বুদ্ধি না। বড়দের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে একটা রাস্তা। বড়রা আমাদের বুঝতে পারে না তো, তাই মাঝে মাঝে এরকম একটা দুইটা বুদ্ধি বের করতে হয়।”
“তুমি আগেও এরকম করেছ?”
টুনি মাথা নাড়ল, “করেছি। নিজের জন্যে করতে হয় নাই, অন্যদের জন্যে করেছি। যেরকম আজকে একটু আগে-”
“একটু আগে কী?”
“ঐ যে কোচিং ক্লাশে মাইক্রো ভয়েস রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করেছি।”
আইরিন চোখ কপালে তুলে বলল, “ঐটা ভূয়া?”
“হ্যাঁ।”
“ডিটেকটিভ এজেন্সী? সেটাও ভূয়া?”
“না, ওটা সত্যি। আমার ছোটাচ্চুর আসলেই একটা ডিটেকটিভ এজেন্সী আছে। তবে ছোটাচ্চু কোচিং সেন্টারের দুই নম্বুরী কাজ কর্ম দেখার জন্যে আমাকে পাঠায় নাই।”
“তাহলে কী জন্যে পাঠিয়েছে?”
টুনি হঠাৎ করে বিপদে পড়ে গেল। ইচ্ছা করলেই সে বানিয়ে একটা উত্তর দিতে পারে, আইরিন কোনোদিন সেটা ধরতে পারবে না। কিন্তু যে মেয়েটার সাথে আইসক্রিম ভাগাভাগি করে খেতে খেতে বন্ধুর মত গল্প করে করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে প্ল্যান এ দাড়া করাচ্ছে তার সাথে কেমন করে মিথ্যা কথা বলে? তাই সে সত্যি কথাটাই বলল, “আইরিন, আমার এসাইনমেন্টটা তোমাকে বলা যাবে না।”
আইরিন হঠাৎ করে দাড়িয়ে গেল, তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে টুনির দিকে তাকালো তারপর মেঘ স্বরে বলল, “তুমি আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে গিয়েছ? ঠিক কী না? আমার আম্মু তোমার ছোটাচ্চুকে আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্যে পাঠিয়েছে। সত্যি কী না বল।”
টুনি ইচ্ছে করলেই হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতে পারত কিন্তু সেটা করল না। অপরাধীর মত মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি।”
আইরিন কয়েক সেকেন্ড টুনির দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি তাহলে আমার উপরে গোয়েন্দাগিরি না করে চলে যাচ্ছ কেন?
ধরা যখন পড়েই গিয়েছে তখন সত্যি কথা বলাটাই ভালো। টুনি বলল, “আমার যা জানার দরকার জেনে গিয়েছি।”
“কী জেনেছ?”
“তুমি মোটেও ড্রাগ খাও না। লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প বই পড়। এখন পড়ছ এরিখ মারিয়া রেমার্কের লেখা থ্রী কমরেডস। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়া হয়েছে। কোচিং ক্লাশের পিছনের শেলফের দ্বিতীয় তাকের পিছনে তুমি বইটা লুকিয়ে রাখ।”
আইরিন চোখ কপালে তুলে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল তার তারপর বলল, “তুমি কেমন করে জান?”
“কোচিংয়ের ঘরটাতে বসে বসে তোমাকে লক্ষ্য করেছি। খুবই সোজা। আজকে তুমি আসার আগে শেলফের পিছনে বইটা দেখেছি। একশ বাহান্ন পৃষ্ঠাটা ভাঁজ করা ছিল।” টুনি কথা শেষ করে আইরিনের দিকে তাকাল তারপর বলল, “তুমি কী আমার উপর রাগ হয়েছ?”
আইরিন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না, তোমার উপর রাগ হয়ে কী করব। রাগ হচ্ছে আমার আম্মুর উপর। আমাকে এইটুকু বিশ্বাস করে না। দেখেছ?”
টুনি আইরিনের পিঠে বন্ধুর মত হাত রেখে বলল, “প্লীজ তুমি আমার উপর রাগ হয়ো না। চল এক জায়গায় বসে তোমার প্ল্যান এ ঠিকমত রেডি করি যেন কোনোদিন তোমার প্ল্যান বি পর্যন্ত যেতে না হয়। তোমার প্ল্যান বি খুবই ডেঞ্জারাস।”
আইরিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চল।”

রাত্রে দাদীর (কিংবা নানী) বসার ঘরে সবাই বসে নিজের কাজ কর্ম করছে। এক কোনায় বসে বাচ্চারা খেলছে। ঝুমু খালা ট্রেতে করে তার বিখ্যাত পায়েশের মত চা নিয়ে এসেছে সবাই কাড়াকাড়ি করে সেটা খাচ্ছে, তখন ছোটাচ্চু বসার ঘরে ঢুকল। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বাঘের মত গর্জন করে বলল, “টুনি কই?”
টুনি বাচ্চাদের মাঝেই ছিল, চিঁ চিঁ করে বলল, “এই যে এইখানে।”
“এক্ষুনি আমার ঘরে আয়। তোর সাথে কথা আছে।”
কোচিং সেন্টারে গোলমাল পাকিয়ে বের হওয়ার পর টুনির সাথে আর ছোটাচ্চুর দেখা হয় নাই। তার মাঝে এতো কিছু ঘটে গেছে যে ছোটাচ্চু রেগে যেতেই পারে। টুনির বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকে, কিন্তু সে খুবই শান্ত ভঙ্গীতে ছোটাচ্চুর পিছু পিছু তার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে। বাচ্চারা সবাই উঠে দাড়ালো তারপর তারাও লাইন বেঁধে টুনির পিছু পিছু ছোটাচ্চুর ঘরে রওনা দিল।
ছোটাচ্চু তার ঘরে ঢুকে পিঠ সোজা করে চেয়ারে বসল, তারপর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি টুনিকে ডেকেছি। তোদের কাউকে ডাকিনি। তোর বের হ।”
বাচ্চারা কেউ বের হবার কোনো লক্ষণ দেখালো না। যে যেভাবে দাড়িয়ে আছে সেভাবেই দাড়িয়ে থাকল। ছোটাচ্চু আবার গর্জন করল, “কী বলছি? কথা কানে যায় না? বের হ সবাই। গেট আউট।”
বাচ্চারা নড়ল না, ছোটাচ্চুর কথা না শোনার ভাণ করে দাড়িয়ে রইল। টুনি বলল, “ছোটাচ্চু তুমি যেটা বলতে চাও সবার সামনে বলে ফেল। এই বাসায় সবাই সবকিছু জানে। কোনো গোপন জিনিস নাই।”
ছোটাচ্চু আস্তে আস্তে আরো রেগে উঠল, তারপর কঠিন গলায় বলল, “আজ সকালে কেন প্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে ফোন করে তোর কথা আমার কাছে জানতে চাইল? কেন?”
ছোটাচ্চু কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “কোচিং সেন্টার? ইয়াক থুঃ। ছি ছি ছি। ঘেন্না ঘেন্না। বমি করে দেই। টুনি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে? হায় হায় হায়!”
টুনি বলল, “আমি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই নাই। ছোটাচ্চুর একটা কেস সলভ করার জন্যে ছোটাচ্চু আমাকে পাঠিয়েছিল।”
বাচ্চারা তখন একটু শান্ত হয়। একজন বলল, “তাই বল!”
আরেকজন বলল, “ভিতরে কী রকম টুনি আপু? লোকজন কী চাবুক নিয়ে থাকে?”
“ব্রেন নষ্ট করার জন্য কী জানি ওষুধ খাওয়ায় সেইটা কী সত্যি?”
“যারা যায় তার নাকী আস্তে আস্তে জম্বির মত হয়ে যায়?”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা বন্ধ করবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বল, আজকে সন্ধ্যেবেলা প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার সাথে টাকার বস্তা নিয়ে দেখা করতে এসেছে? কেন আমাকে বলছে গভমেন্টকে রিপোর্ট না দিতে তাহলে আমাকে সেই টাকার বস্তা দিয়ে দিবে? তুই কী করেছিস? কী বলেছিস তাদের?”
শান্ত আনন্দে চিৎকার করে বলল, “টাকার বস্তা? কোথায় ছোটাচ্চু টাকার বস্তাটা? আমাদেরকে দেখাও!”
আরেকজন বলল, “কতো টাকা ভিতরে? গুনেছ?”
শান্ত বলল, “আমাদেরকে দাও ছোটাচ্চু, গুনে দেই! খোদার কসম এক টাকাও সরাবো না।”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে বলল, “তোরা কী ভেবেছিস আমি দুই নম্বরী মানুষ? কেউ টাকার বস্তা নিয়ে আসলেই আমি সেটা নিয়ে নেব?”
শান্ত বলল, “ঠিক আছে তুমি না নিলে, আমাদেরকে দিয়ে দাও! কী বলিস তোরা?”
বাচ্চারা মাথা নাড়ল। ছোটাচ্চু আরো রেগে উঠল বলল, “তোরা তোদের ফালতু কথা থামাবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই বল। কী হয়েছে?”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু। কিছুই হয় নাই। তুমি আইরিনকে ওয়াচ করার জন্য পাঠিয়েছ, আমি ওয়াচ করেছি। মেয়েটা খুবই সুইট। কোনো রকম সমস্যা নাই, গল্প বই পড়তে ভালোবাসে। বইয়ের শেলফে মোটেও ইয়াবা লুকিয়ে রাখে না, গল্প বই লুকিয়ে রাখে। থ্রী কমরেডস, এরিখ মারিয়া রেমার্কের বই। এরিখ মারিয়া রেমার্ক চিনেছ তো? যে অল কোয়ায়েট ইন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট লিখেছিল।”
ছোটাচ্চু ধমক দিয়ে বলল, “আমাকে তোর এরিখ মারিয়া রেমার্ককে চিনাতে হবে না। যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে। প্যারাগন কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমাকে টাকা ঘুষ দিতে চায়?”
টুনি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেওয়ার মত করে বলল, “ওটা কিছু না।”
“কিছু না মানে? কোচিং সেন্টারের লোকজন কেন আমার কাছে টাকার বস্তা নিয়ে আসবে? কী করেছিস তুই?”
টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু করি নাই। শুধু-”
“শুধু কী?”
“যে লোকটা মডেল টেস্ট নেয় তার উচ্চারণ খুব খারাপ। প্যারাগনকে বলে ফ্যারাগন, গোলাপ ফুলকে বলে গোলাফ পুল, প্রত্যেককে বলে ফরতেক-”
বাচ্চারা হি হি করে হাসতে থাকে তখন ছোটাচ্চু তাদেরকে একটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”
বাচ্চারা চুপ করল। ছোটাচ্চু, “উচ্চারণ খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, “কিছু হয় নাই। কিন্তু যখন বলল, পরীক্ষার আগেই তারা পরীক্ষার প্রশ্ন দিয়ে দেবে-”
“তাই বলেছে?”
“না। বলেছে ফরীক্ষার ফ্রশ্ন- মানে পরীক্ষার প্রশ্ন।”
“তখন তুই কী করেছিস?”
“তখন আমি ভাণ করেছি তার কথা রেকর্ড করেছি। যখন আমার ভূয়া ভয়েস রেকর্ডার কেড়ে নিতে চেয়েছে তখন তোমার আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর কথা বলে একটু ভয় দেখিয়েছি।”
বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, “ঠিক করেছে। টুনি ঠিকই করেছে। একশ বার!”
শান্ত বলল, “প্যারাগন কোচিং সেন্টারকে জ্বালিয়ে দিতে হবে।”
আরেকজন বলল, “জ্বালো জ্বালো। আগুন জ্বালো।”
অন্যেরা বলল, “ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।”
তখন সবাই চিৎকার করে উঠল, “ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক।”
ছোটাচ্চু আরেকটা মেগা ধমক দিল, “চুপ করবি তোরা?”
বাচ্চারা চুপ করল তখন ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে এখন আমি কী করব?”
টুনি হাত উল্টে বলল, “তোমার ইচ্ছা!”
তারপর খুবই শান্ত ভঙ্গিতে ছোটাচ্চুর ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বাচ্চারাও তার পিছু পিছু বের হয়ে এলো। শান্ত চিৎকার করে বলল, “টুনি টুনি টুনটুনি-”
অন্যেরা চিৎকার করে বলল, “লাল গুলাফের শুভেচ্ছা!” তারপর সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল।

ছোটাচ্চুর ঘরে যখন এসব ঘটছে তখন আইরিনের বাসায় সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করেছে।
আইরিনের আম্মু টেবিলে খাবার দিয়ে গলা উচু করে আইরিনকে খেতে ডাকলেন। আইরিন তার ঘরে, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। তখন আম্মু আবার ডাকলেন, এবারেও আইরিন কোনো জবাব দিল না। তখন আইরিনের আব্বু ডাকলেন, “আইরিন মা,খেতে আয়।”
এবারেও কোনো জবাব না শুনে আম্মু আর আব্বু দুইজনেই তার ঘরে গেলেন। দেখলেন আইরিন তার পড়ার টেবিলে পিঠ সোজা করে বসে আছে, হাতে একটা বই ধরে রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। আম্মু আইরিনের পিঠে হাত দিয়ে ডাকলেন, “আইরিন।”
আইরিন কেমন যেন ভয়ানকভাবে চমকে উঠে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী? কী? কী হয়েছে? কী হয়েছে আম্মু?”
আম্মু বললেন, “খেতে ডাকছি, শুনিসনি?”
“না আম্মু অংকটা মুখস্ত করছিলাম। শুনি নাই।”
“পরে মুখস্ত করবি। আয় খেতে আয়।”
আইরিন উঠে দাড়াল তারপর অনেকটা রবোটের মত হেঁটে হেঁটে খাবার টেবিলে গিয়ে পিঠ সোজা করে বসে রইল। চোখটা আধ খোলা, ঠোট নড়ছে, কিছু একটা বিড় বিড় করে বলছে।
আম্মু আর আব্বু অবাক হয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আব্বু বললেন, “খেতে বসেছিস, এখন খা, মা।”
আইরিন বলল, “খাব আব্বু।”
আম্মু প্লেটে ভাত দিলেন। আইরিন ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, একটা একটা করে ভাত গুনতে লাগল।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী করিস?”
আইরিন গোনা থামিয়ে বলল, “কিছু করি না।”
আম্মু প্লেটে শবজি দিলেন। একটা বড় পাবদা মাছ দিলেন, আইরিনের পছন্দের মাছ। আইরিন শবজি দিয়ে ভাত খেয়ে মাছটা খেতে গিয়ে থেমে গেল। মাথা নিচু করে প্লেটের সাথে প্রায় মাথাটা ছুইয়ে মাছের মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, “কী করিস?”
“দেখি আম্মু। মাছটা কেমন করে তাকিয়ে আছে দেখেছ?”
আম্মু আবার ধমক দিয়ে বললেন, “মাছ আবার তাকিয়ে থাকে কেমন করে? খেতে বসেছিস খা।”
আইরিন মাছটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইল, ডানে বামে মাথাটা নাড়াল, তারপর খেতে শুরু করল। আম্মু ধমক দিলেন, বললেন, “ঢং করবি না। ঠিক করে খা।”
আব্বু বললেন, “আহ্। কেন বকছ। মেয়েটাকে খেতে দাও।”
আইরিন খাওয়া শেষ করে আবার টেবিলে বসে দুলে দুলে অংক মুখস্ত করতে লাগল। রাত বারোটার সময় আম্মু এসে দেখলেন তখনো আইরিন গুন গুন করে কিছু একটা পড়ছে। আম্মু নরম গলায় বললেন, “যা, এখন ঘুমাতে যা।”
আইরিন বলল, “আর দুইটা অংক মুখস্ত করে নিই আম্মু।”
আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা, অনেক সকালে উঠতে হবে।”
“তাহলে আরেকটা অংক মুখস্ত করি? মাত্র একটা?”
“না। এখন ঘুমা।”
“পরে যদি গোল্ডেন ছুটে যায়?” কথা শেষ করে আইরিন কেমন জানি শিউরে উঠল।
আম্মু বললেন, “এখন ঘুমা।”
আইরিন তখন বাধ্য মেয়ের মত ঘুমাতে গেল। একদিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে।

পরের দিন স্কুল থেকে এসে আইরিন ব্যাগটা ঘরে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। আম্মু এসে বললেন, “কী হয়েছে? শরীর খারাপ?
“না আম্মু। একটু মনে মনে রিভিশন দিচ্ছি।”
“যা, গোসল করে খেতে আয়।”
আইরিন উঠে বাথরুমে গেল এবং আম্মু সাথে সাথে শাওয়ারের শব্দ শুনতে পেলেন। আম্মু অবাক হয়ে সাবধানে বাথরুমের দরজায় উঁকি দিলেন, দেখলেন স্কুলের পোশাক পরে আইরিন শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে আছে। ঝরঝর করে পানি তার চুল মাথা বেয়ে কাপড় ভিজিয়ে পড়ছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস তুই? কী করছিস?”

আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস তুই? কী করছিস?”

আইরিন জানতে চাইল, “কী করছি?”
“স্কুল ড্রেস পরেই গোসল করছিস?”
আইরিন অবাক হয়ে নিজের দিকে তাকাল, তারপর জিবে কামড় দিয়ে বলল, “হায় হায়! কী বোকা আমি!”
আইরিন শাওয়ার থেকে বের হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু দেখলেন তার হাতে মার্কার দিয়ে লেখা গোল্ডেন ফাইভ! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল হাতে গোল্ডেন ফাইভ লিখেছিস কেন?”
“যেন ভুলে না যাই। গোল্ডেন ফাইভ পেতেই হবে। তাই না আম্মু?”
আম্মু দুর্বল গলায় বললেন, “হ্যাঁ। পেতে হবে।”
আইরিন গলা উচিয়ে বলল, “পেতে হবে না। পেতেই হবে।”

আইরিনের পবির্তনটা খুবই স্পষ্ট। সারাক্ষণই বিড় বিড় করে কিছু একটা মুখস্ত করছে। কথা বললে একেবারে শুনতে পায় না। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে হঠাৎ শুনতে পায় এবং তখন ভীষণভাবে চমকে উঠে। খেতে বসলে অন্যমনস্ক ভাবে খেতেই থাকে। রাতে ঘুমায় না। বাসায় সব আলো জ্বালিয়ে হাতে একটা বই নিয়ে মুখস্ত করতে করতে সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায়। বিড় বিড় নিজের মনে কথা বলে। একদিন গভীর রাতে রান্নাঘরে টুকটাক শব্দ শুনে আম্মু গিয়ে দেখেন বিশাল একটা ডেকচিতে পানি চাপিয়ে আইরিন সেখানে চাল দিয়ে পানি গরম করছে। আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “কী করছিস আইরিন.”
“ভাত রান্না করছি।”
“কেন?”
প্রশ্নটা শুনে আইরিন খুব অবাক হয়ে গেল, বলল, “কেন আম্মু? ভাত রান্না করতে হবে না?”
আম্মু বললেন, “না তোকে ভাত রান্না করতে হবে না। ঘুমুতে যা।”
আইরিন বলল, “ঘুমাতে পারি না, আম্মু।”
“ঘুমাতে পারিস না?”
“না, ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি পরীক্ষা দিচ্ছি আর একটা প্রশ্নের উত্তরও মনে পড়ছে না। সব ভুলে গেছি। তখন মনে হয় গোল্ডেন ফাইভ হবে না। তখন ভয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর ঘুম আসে না।”
আম্মু বললেন, “তোকে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।”
আইরিন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, আম্মু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। আমার কিছু হয় নাই। আমি ভালো আছি একদম ভালো আছি। আমার কোনো ঝামেলা নাই আম্মু। আমি ভালো আছি।”
আম্মু তখন আইনিরকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেন। আইরিন লম্বা হয়ে চোখ খোলা রেখে শুয়ে থাকে।
সকাল বেলা ডাইনিং টেবিলে আম্মু দেখলেন আইরিনের চোখ লাল (চোখ সাবান দিয়ে একটু ডলে দিলেই চোখ লাল হয়ে যায়) চোখের নিচে কালি (মার্কারের কালো রং হাতে লাগিয়ে চোখের নিচে ঘষে লাগানো হয়েছে) চুল এলোমেলো (হাত দিয়ে খিমচে খিমচে চুল এলোমেলো করা হয়েছে), চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত এবং ডান হাতটা একটু একটু কাঁপছে (এই দুটো অভিনয়)। আম্মু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “কী হয়েছে আইরিন?”
আইরিন জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কিছু হয় নাই আম্মু। কিছু হয় নাই।”
“রাতে ঘুম হয়েছে?”
“হ্যাঁ আম্মু হয়েছে। শুধু-”
“শুধু কী?”
“শুধু সারারাত স্বপ্ন দেখেছি।”
“কী স্বপ্ন দেখেছিস?”
“পরীক্ষা হচ্ছে আর আমি কোনো উত্তর মনে করতে পারছি না। তখন-”
“তখন কী?”
“কলম দিয়ে যেটাই লিখি লেখা হয় গোল্ডেন ফাইভ। আমি কাগজের পাতায় শুধু লিখছি গোল্ডেন ফাইভ গোল্ডেন ফাইভ-”
আম্মু মুখ কালো করে বললেন, “গোল্ডেন ফাইভ নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কী আছে?”
“ঠিকই বলেছ আম্মু।” আইরিন বলল, “এতো বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। কিন্তু-”
“কিন্তু কী?”
“আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি লেখা আছে গোল্ডেন ফাইভ।”
আইরিন মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাল, তারপর বলল, “না আম্মু এখন দেখছি না।”
আম্মু বললেন, “না দেখলেই ভালো।”
আইরিন স্কুলে যাবার পর আম্মু তার ঘরে গিয়ে চমকে উঠলেন, সারা দেওয়ালে মার্কার দিয়ে লেখা, গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!
হঠাৎ করে আম্মু কেমন জানি অসুস্থ বোধ করতে থাকেন। মনে হতে থাকে মেয়েটাকে চাপ দিয়ে বুঝি তার একটা বড় সর্বনাশ করে ফেলেছেন। আইরিনের বিছানায় বসে আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন।

রাত্রে ছোটাচ্চু টুনিকে বললেন, টুনি তোর মনে আছে তোকে আইরিন নামে একটা মেয়েকে ওয়াচ করার জন্যে একটা কোচিং সেন্টারে পাঠিয়েছিলাম?”
“মনে আছে ছোটাচ্চু।”
“সেই মেয়েটার খুব সিরিয়াস সমস্যা।”
টুনিকে খুব দুশ্চিন্তিত মনে হলো না। বলল, “কী সমস্যা?”
“মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যাচ্ছে?”
“তাই নাকী?”
“হ্যাঁ। তার মা আমাকে ফোন করেছিল। মেয়েটার ভয়াবহ অবস্থা-”
“কেন? কী করে?”
“প্রথমে দিনরাত শুধু অংক মুখস্ত করত। তারপর দেখা গেল ঘুমাতে পারে না। তারপর-”
টুনি হাত তুলে বলল, “দাড়াও, আমি বলি। তারপর সারা রাত লাইট জ্বালিয়ে সারা বাসায় বই মুখস্ত করতে করতে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলের পোশাক পরে শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে থাকে। রাত্রে বেলা বড় ডেকচিতে ভাত রান্না করে, ঘরের দেওয়ালে লিখে রাখে গোল্ডেন ফাইভ! গোল্ডেন ফাইভ!গোল্ডেন ফাইভ!”
ছোটাচ্চু হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “তু-তু-তুই কেমন করে জানিস?”
“কারণ এইটা হচ্ছে প্ল্যান এ। এরপর আইরিন সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করবে। কাউকে চিনবে না। আরো আছে। শুনতে চাও?”
“তার মানে আইরিনের আসলে কিছু হয়নি। পুরোটা অভিনয়?”
টুনি মাথা নাড়ল, “পুরোটা প্ল্যান এ। সে নিজে যেটা প্ল্যান করেছিল সেটা অনেক ডেঞ্জারাস। সেটা এখন প্ল্যান বি। অনেক বুঝিয়ে তাকে প্ল্যান এ’তে রাজি করিয়েছি। যদি এই প্ল্যান কাজ করে তাহলে প্ল্যান বি’তে যেতে হবে না। বুঝেছ?”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, “তুই ভয়ংকর ডেঞ্জারাস!”
“না ছোটাচ্চু আমি ডেঞ্জারাস না। তোমরা- বড় মানুষেরা হচ্ছ ডেঞ্জারাস।”
“তুই কেমন করে এটা করলি? বেচারী মায়ের অবস্থা কী তুই জানিস? হাউ মাউ করে কাঁদছে।”
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি সব ঠিক করে দাও। মা’কে বোঝাও যেন আর কখনো গোল্ডেন ফাইভের জন্যে চাপ না দেয়। বোঝাও যেন আইরিনকে নিজের মত করে লেখা পড়া করতে দেয়, গল্প বই পড়তে দেয়, প্রাইভেট কোচিং থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। বোঝাও তাহলে আইরিন ঠিক হয়ে যাবে।”
ছোটাচ্চু তখনো হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। আবার বিড় বিড় করে বলল, “টুনি! তুই সাংঘাতিক ডেঞ্জারাস।”
টুনি কথা না শোনার ভাণ করে বলল, “ছোটাচ্চু তুমি এখনই আইরিনের আম্মুকে ফোন করো। এক্ষুনি।”
ছোটাচ্চু ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “ঠিক আছে করছি।”

দুই দিন পর সবাই বসার ঘরে বসে আছে, দাদী (কিংবা নানী) টেলিভিশনে বাংলা সিরিয়াল দেখছেন। বড় চাচা খবরের কাগজ পড়ছেন। কয়েকজন চাচী খালা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন, ঝুমু খালা ডালপুরী ভেজে এনেছে বাচ্চারা সেগুলো কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে ঠিক তখন ছোটাচ্চু বিশাল একটা কেক নিয়ে হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে হই হই করে উঠল। কেকটা নিয়ে টানাটানি করতে থাকল। একজন বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু, থ্যাংকু!”
ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে থ্যাংকু দিতে হবে না। থ্যাংকু যদি দিতে চাস আমার একজন ক্লায়েন্টকে থ্যাংকু দে। আইরিন নামে একটা মেয়ের মা এই কেকটা নিয়ে এসেছে।”
কেকটাকে বাক্স থেকে বের করতে করতে একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন কেক এনেছে আইরিনের মা?”
“লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপে মেয়েটার নার্ভাস ব্রেক ডাউনের মত হয়েছিল। আমি তখন মাকে কয়েকটা আইডিয়া দিলাম, সেই আইডিয়া মতোন কাজ করার পর মেয়েটা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে!”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া দিয়েছিলে ছোটাচ্চু?”
“পড়াশোনার কোনো চাপ না দিতে। যেটা পছন্দ করে সেটা করতে দিতে। বইয়ের দোকানে গিয়ে অনেকগুলো গল্প বই কিনে সেগুলো পড়তে দিতে, প্রাইভেট কোচিং এসব থেকে সরিয়ে নিতে। এই রকম কয়েকটা আইডিয়া।”
শান্ত বলল, “এইগুলোতো সবাই জানে- আমিও দিতে পারতাম।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “আইরিনের মা সবগুলো আইডিয়া শুনেছে?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “সব। মেয়েটাকে নিয়ে অফিসে এসেছিল। হাসিখুশী সুইট একটা মেয়ে। তোর মতো বড় বড় চশমা। হাতে মোটা একটা বই।”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার মুখটা একটু নামাবে?”
“কেন?”
“আগে নামাও।”
ছোটাচ্চু মুখটা নামাল তখন টুনি ছোটাচ্চুর দুই গালে দুইটা চুমু দিয়ে বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু।”

টুনি ছোটাচ্চুর দুই গালে দুইটা চুমু দিয়ে বলল, “থ্যাংকু ছোটাচ্চু।”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে থ্যাংকু টুনি?”
টুনি কিছু বলার আগেই শান্ত বলল, “কী জন্যে আবার! এতো বড় একটা কেক এনেছে সেই জন্যে। তাই না টুনি?”
টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, ছোটাচ্চু খুব সাবধানে কেউ যেন দেখতে না পায় সেভাবে টুনির দিকে তাকিয়ে একটু চোখ টিপে দিল। টুনি তখন শান্ত এর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। কেকটার জন্যে। এইটা আমার সবচাইতে ফেভারিট কেক!”

শিশুতোষ
shisutosh

মিতুল ও তার রবোট


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সকাল বেলা আম্মু মিতুলকে বললেন, “মিতুল, মামনি, তোমার ঘরটা আজকে একটু পরিস্কার করে রেখো।”
মিতুল মুখটা শক্ত করে বলল, “আমার ঘরটা সব সময় পরিস্কার থাকে আম্মু।”
আম্মু ফিক করে হাসলেন, বললেন, “আজকে একটু বেশি পরিস্কার করতে হবে মামনি। তোমার খেলনাগুলো ঘরের মাঝখান থেকে একটু সরিয়ে রাখতে হবে।”
মিতুল জিজ্ঞেস করল, “কেন আম্মু?”
আম্মু বললেন, “আজকে রাত্রে তোমার ঘরে একজন থাকবে।”
মিতুলদের বাসায় যখন মেহমান আসে তখন সেই মেহমান মিতুলের ঘরে থাকে। মিতুল তখন আব্বু আম্মুর সাথে ঘুমায়।
মিতুল জিজ্ঞেস করল, “কে আসবে আম্মু?”
আম্মু বললেন, “তোমার ছোট মামা।”
মিতুল তখন আনন্দে হাততালি দিল, বলল, “ছোট মামা! কী মজা।”
মিতুলের ছোট মামা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। যখন তাদের বাসায় আসে তখন মিতুলের অনেক মজা হয়। আব্বু আম্মু মিতুলকে যে কাজগুলো করতে দেন না, ছোট মামা তাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই কাজগুলো করে ফেলে- আব্বু আম্মু জানতেও পারে না! তাদের ক্লাশের সবচেয়ে পাজী ছেলেটাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে ছোট মামা মিতুলকে একটা যন্ত্র তৈরী করে দিয়েছিল। সেই যন্ত্রে চাপ দিতেই সেখান থেকে পিচকারির মত পানি বের হয়ে ছেলেটাকে ভিজিয়ে দিয়েছিল! কী যে মজা হয়েছিল তখন! ছোট মামা যে কোন যন্ত্র তৈরী করতে পারে। ছোট মামা বলেছে মিতুল যখন আরেকটু বড় হবে তখন তাকেও সব রকম যন্ত্র তৈরী করা শিখিয়ে দেবে।
মিতুল আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “ছোট মামা কয়দিন থাকবে আম্মু?”
আম্মু বললেন, “তোর ছোট মামা তো থাকবে না, একজনকে তোর ঘরে রেখে যাবে!”
মিতুল প্রায় চিৎকার করে বলল, “ছোট মামা থাকবে না?”
“না মামনি। ছোট মামার সাথে তার আরও বন্ধুরা আছে তো, তাই সবাই মিলে হোস্টেলে থাকবে। শুধু একজনকে রেখে যাবে।”
“একজনকে কেন রেখে যাবে? সে কেন হোস্টেলে থাকবে না?”
আম্মু মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, “আমি তো সেটা জানি না! তোর ছোট মামা বলেছে তাকে হোস্টেলে থাকবে দিবে না! তাকে তোর ঘরে থাকতে হবে।”
মিতুল তখন একটু দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে গেল। মানুষটা নিশ্চয়ই খুবই দুষ্টু, তা না হলে মানুষটাকে হোস্টেলে থাকতে দিবে না কেন? দুষ্টু মানুষটা যদি তার খেলনাগুলো ভেঙ্গে ফেলে তখন কী হবে?
দুপুরবেলা ছোট মামা তার বন্ধুদের নিয়ে মিতুলদের বাসায় হাজির হল। কলিং বেলের শব্দ শোনে মিতুল দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। দরজার সামনে তার ছোট মামা, ছোট মামার সাথে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে, আর কী আশ্চর্য তাদের পিছনে মানুষের মত দেখতে একটা যন্ত্র। যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষটার হাত পা আছে, মাথা আছে, চোখ নাখ মুখ সবই আছে কিন্তু সেটা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। মিতুল অবাক হয়ে যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল।

মিতুল অবাক হয়ে যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ছোট মামা চোখ নাচিয়ে বলল, “কী হল মিতুল! আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিবি না?”
মিতুল বলল, “তোমাদের পিছনে ওটা কী ছোট মামা?”
ছোট মামা বলল, “ওর নাম হচ্ছে গুবট। সব কিছু গুবলেট করে ফেলে বলে ওর নাম হচ্ছে গুবট। গুবট হচ্ছে একটা রবোট।”
মিতুল জিজ্ঞেস করল, “রবোট কী ছোট মামা?”
ছোট মামা বলল, “রবোট হচ্ছে যন্ত্র দিয়ে তৈরী মানুষ। আমাদের আগে ভিতরে ঢুকতে দে তারপর তোকে দেখাব।”
মিতুল দরজা খুলে সরে দাড়াল। মিতুল ভেবেছিল রবোটটা বুঝি হেঁটে হেঁটে ঢুকবে, কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল সবাই মিলে তাকে ঠেলে ঠেলে ঘরে ঢোকাল।
মিতুল জিজ্ঞেস করল, “এই রবোটটা নিজে নিজে হাঁটতে পারে না?”
ছোট মামা বলল, “এখনো পারে না। আস্তে আস্তে শিখবে।”
“কথা বলতে পারে?”
“একটু একটু পারে।”
মিতুল তখন রবোটটাকে জিজ্ঞেস করল, “এই রবোট, তোমার নাম কী?”
রবোটটা কোনো কথা বলল না, সোজা হয়ে দাড়িয়ে রইল।
ছোট মামার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল সে বলল, “রবোটের সুইচটা অন করা না হলে এটা কথা বলবে না।”
“তাহলে সুইচটা অন করো।”
ছোট মামা বলল, “আগে গুবটকে তোর ঘরে নিয়ে যাই। সেখানে অন করব।”
তখন সবাই মিলে ঠেলে ঠেলে ররোটটাকে মিতুলের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের মাঝখানে সেটাকে দাড়া করিয়ে ছোট মামা বলল, “গুবট আজ রাত তোর ঘরে থাকবে। কাল ভোর বেলা গুবটকে নিয়ে যাব।”
“কোথায় নিয়ে যাবে মামা?”
“রবোটের কম্পিটিশান হচ্ছে, সেখানে নিয়ে যাব।”
“রবোটের কম্পিটিশানে কী হয় ছোট মামা?”
“সব ইউনিভার্সিটি থেকে ছেলেমেয়েরা রবোট তৈরী করে নিয়ে আসে। তখন রবোটদের নানা রকম প্রশ্ন করে, রবোটদের উত্তর দিতে হয়। যাদের রবোট সবচেয়ে ভাল করে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। তাদের রবোট চ্যাম্পিয়ন হবে।”
মিতুল জিজ্ঞেস করল, “কী প্রশ্ন করে, ছোট মামা?”
“এই তো- তোমার নাম কী। তুমি কী কর। হাত তোল। হাত নামাও। আমার সাথে হ্যান্ড শেক কর। একটা গান গাও। হয়তো একটা বল দিয়ে বলবে, এই বলটা ধরো। বলটা ছুড়ে দাও।”
মিতুল অবাক হয়ে বলল,“এতো সোজা সোজা প্রশ্ন! এগুলো তো আমিও পারি।”
ছোট মামার সাথে যে মেয়েটা এসেছিল সে হি হি করে হেসে বলল, “তুমি কেন পারবে না? তুমি একশ বার পারবে। তুমি তো মানুষ। মানুষের বুদ্ধি কতো বেশি!”
মিতুলের তখন একটু মন খারাপ হলো, সে ভেবেছিল রবোটের বুদ্ধি বুঝি অনেক বেশি হয়- তারা বুঝি অনেক কিছু করতে পারে।
এ রকম সময় মিতুলের আম্মু মিতুলের ঘরে এসে ঢুকলেন। রবোটটাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “ও মা! এতো বড় রবোট নিয়ে এসেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম ছোট একটা রবোট হবে, মিতুলের সাইজের!”
ছোট মামা মাথা নেড়ে বলল, “না আপা! কম্পিটিশানের জন্যে রবোটটাকে বড় মানুষের সমান বড় হতে হবে!”
“তোদের রবোট কী করতে পারে? আমাদের দেখা।”
ছোট মামা বলল, “খুব বেশি কিছু করতে পারে না আপা। কয়েকটা প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারে, একটু হাত পা নাড়াতে পারে, এই সব।”
মিতুল বলল, “আমরা দেখতে চাই ছোট মামা। আমাদের দেখাও।”
“দেখাচ্ছি।” বলে ছোট মামা রবোটের পিছন থেকে একটা লম্বা তার বের করে প্লাগের মাঝে লাগাল। মেয়েটা তখন রবোটের মাথার পিছনে কানের কাছে একটা সুইচ অন করে দিল।
রবোটটা তখন একটু কেঁপে উঠল, তার ভেতর তখন শোঁ শোঁ করে একটা শব্দ হতে লাগল। তার মাথার ভিতরে তখন লাল নীল আলো জ্বলতে লাগল। রবোটটা তখন আস্তে আস্তে তার একটা হাত তুলে নিচে নামিয়ে এনে বলল, “হ্যা-লো। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট।”
কথাগুলো ভাল করে বোঝাই যায় না। ছোট মামা জিজ্ঞেস করল, “রবোট, তোমার নাম কী?”
রবোটটা খুব আস্তে আস্তে মাথা ঘুরিয়ে ছোট মামার দিকে তাকাল, তারপর বলল, আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট।”
ছোট মামা বলল, “গুবট তোমার হাত উপরে তুলো।”
রবোটটা বলল, “আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট আ-মা-র না-ম গু-ব-ট…”
ছোট মামা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “গুবট। হাত উপরে তুলো।”
রবোটটা ছোট মামার কথা শুনল বলে মনে হল না, বলতে থাকল, “আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট…”
মেয়েটা মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় সিস্টেম রিবুট করতে হবে। হ্যাং হয়ে গেছে।”
ছোট মামা মাথা নাড়ল, বলল, “সুইচটা অফ করে আবার অন করো।”
আম্মু বললেন, “পরে সুইচ অন অফ করিস। এখন যা, হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়।”
মিতুল বলল, “ছোট মামা।”
ছোট মামা বলল, “উঁ।”
মিতুল বলল, “তোমার রবোট, কম্পিটিশানে ফেল করবে। লাড্ডা গাড্ডা হবে। এটাতো কিছুই পারে না।”
ছোট মামা বলল, “কে বলেছে কিছু পারে না? শুনিস নি কথা বলছিল?”
মিতুল বলল, “উল্টা পাল্টা কথা বলেছে ছোট মামা, মনে হচ্ছে মাথা গরম হয়ে গেছে।”
ছোট মামা হেসে ফেলল, বলল, “রবোটেরা এইভাবে মাথা গরম করে কথা বলে!”
মিতুল বলল, “তুমি ঠাণ্ডা মাথার একটা রবোট বানাতে পারবে? যেটা সুন্দর করে কথা বলবে। গল্প করবে। আমার সাথে স্কুলে যাবে-”
ছোট মামা আবার হাসল, বলল, “ঠিক আছে, তোকে একটা ঠাণ্ডা মাথার রবোট বানিয়ে দিব! হ্যান্ডসাম একটা রবোট। তোর সাথে সেই রবোটের বিয়ে দিয়ে দিব।”
মিতুল ছোট মামাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “যাও মামা। তুমি খালি ঠাট্টা কর।”

ছোট মামা আর তার বন্ধুরা মিলে সারা বিকাল রবোটটা নিয়ে কাজ করল। সন্ধ্যেবেলা ছোট মামার বন্ধুরা মিতুলের ঘরে রবোটটা রেখে তাদের হোস্টেলে চলে গেল। ছোট মামা যাবার আগে অনেকবার মিতুলকে সাবধান করে গেল যেন সে রবোটের বেশি কাছে না যায়। যদি হাত লেগে রবোটের ভেতরের একটা তার খুলে যায় তাহলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে। ভেতরে যে ইলেক্ট্রনিক আই সি আছে সেগুলো না কী অনেক দামি- অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে, যদি খুলে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মিতুল ছোট মামাকে বলল, সে মোটেও তার রবোটের কাছে যাবে না।
ঘুমানোর সময় আম্মু মিতুলকে বললেন, “মামনি তুমি আজকে আমাদের সাথে ঘুমিয়ে যাও।”
মিতুল বলল, “আমি আমার ঘরেই ঘুমাব আম্মু।”
“তোর ঘরের মাঝখানে এতো বড় একটা রবোট, ভয় পাবি না?”
মিতুল বলল,“না আম্মু। ভয় কেন পাব? এটাতো সুইচ অফ করাই আছে!”
আম্মু বললেন, “সাবধান, রবোটটাকে ভুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিস না যেন।”
মিতুল বলল, “তুমি যে কী বল। আমি কেন ছোট মামার রবোটটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব?”

রাত্রি বেলা মিতুল তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখেছে ছোট মামা রবোটটার কানের কাছে একটা সুইচ টিপে দিয়ে রবোটটাকে চালু করে দেয়। মিতুলের একবার মনে হল সে কানের কাছে সুইচটা অন করে কিছুক্ষণ রবোটটার সাথে কথা বলে, কিন্তু একা একা সেটা করার সাহস হল না। আম্মু এসে তার মশারীটা গুঁজে দিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। তখন অন্ধকারে ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে থাকা রবোটটাকে দেখে মিতুলের কেমন যেন ভয় ভয় লাগল। সে তখন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে গেল।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখল, রবোটটা তার ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক সময় তার বিছানার কাছে এসে রবোটটা তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিয়ে হি হি করে দাত বের করে হাসতে লাগল। মিতুল রেগে গিয়ে বলল, “তুমি হাসছ কেন বোকার মত?”
রবোটটা বলল, “আমার ভেতরে শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে তাই হাসছি।”
মিতুল বলল, “মিথ্যা কথা। শর্ট সার্কিট হলে কেউ হাসে না। শর্ট সার্কিট হলে আগুন ধরে যায়।”
রবোটটা বলল, “এই দেখ আমার ভিতরে আগুন ধরে গেছে।”
মিতুল দেখল সত্যি সত্যি রবোটটার ভেতরে আগুন ধরে গেছে, রবোটটার কান আর নাক দিয়ে গরম বাতাস আর কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। রবোটটা তখন মিতুলের খুব কাছে এসে দাড়াল, গরম বাতাসে মিতুলের তখন গলা শুকিয়ে গেল, সে চিৎকার করে বলল, “যাও, তুমি সরে যাও। আমার গরম লাগছে।”
ঠিক তখন মিতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, তার বুকটা ধুকপুক করছে, গলা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু রবোটটা ঠিকই আছে। ঘরের মাঝখানে রবোটটা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে তার ভেতরে মোটেই আগুন ধরে যায়নি, তার নাক মুখ দিয়ে মোটেই গরম বাতাস আর ধোঁয়া বের হচ্ছে না। শুধু মিতুলের গলা শুকিয়ে গেছে আর বুকটা ধুপপুক করছে। মিতুল তখন আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যাবার চেষ্টা করল।
মিতুলের কেন জানি ঘুম আসছিল না। গলা শুকিয়ে গেছে এক গ্লাশ পানি খেলে মনে হয় ভালো লাগবে। তাই মিতুল খুব সাবধানে তার বিছানা থেকে নামল, ডাইনিং টেবিলের উপর পানির বোতল থাকে। এক ঢোক পানি খেয়ে আসবে।
অন্ধাকারে যেন রবোটটার সাথে ধাক্কা লেগে না যায় সেজন্যে মিতুল খুবই সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে, কিন্তু হঠাৎ করে একটা তারের সাথে পা বেঁধে গেল। রবোটের পাওয়ার কর্ডটা যে তার বিছানার কাছে দিয়ে নিয়ে গেছে সেটা তার একেবারে মনে নেই। মিতুল হুড় মুড় করে পড়ে যাচ্ছিল, কী করছে বোঝার আগেই সে রবোটটাকে জাপটে ধরল, রবোটটা ধাক্কা খেয়ে সামনে সরে যেতে থাকে। মিতুল টের পেল তার হাতে কয়েকটা তার ছুটে এসেছে। মিতুল আছাড় খেয়ে পড়ল, রবোটটাও সামনে টেবিলে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল- অন্ধকারে কী করছে বুঝতে না পেয়েও মিতুল কোনোভাবে রবোটটাকে ধরে ফেলল- কোথায় ধরেছে কে জানে, মিতুলের মনে হল কিছু যন্ত্রপাতি তার হাতে খুলে এসেছে।
মিতুল অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে। ছোট মামা যেটা নিষেধ করেছে সে ঠিক সেই কাজটাই করেছে। রবোটের ভেতরের তারগুলো খুলেছে, যন্ত্রপাতি খুলেছে। এখন কী হবে?
মিতুল সাবধানে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালালো। রবোটটা তার পড়ার টেবিলের কাছে দাড়িয়ে আছে। পিঠের দিকের অংশগুলো খোলা সেখান থেকে অনেকগুলো তার এলোমেলো হয়ে বেরিয়ে আছে। তার হাতে কালো রংয়ের একটা চারকোণা আই সি, সেখান থেকে অনেকগুলো সোনালী রংয়ের পিন বের হয়ে আছে। সে এখন কী করবে? একটু আগে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল- এখন শুধু গলা না বুকের ভেতরটাও শুকিয়ে গেছে।
মিতুল গুটি গুটি পায়ে রবোটটার কাছে এগিয়ে গেল। পিঠের খোলা অংশের কোন জায়গা থেকে আই সি টা খুলে এসেছে বোঝার চেষ্টা করল। একটা জায়গা সে খুজেও পেল, খালি একটা সকেট, মনে হল এখান থেকেই এটা খুলে এসেছে। আর কিছু পারুক আর না পারুক সে আই সি টা অন্তত আগের জায়গায় লাগিয়ে দিতে পারে।

মিতুল সকেটটার মাঝে আই সি টা ঢোকানের চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা ঢুকল না। মিতুল জোরে একটু চাপ দিতেই পুটুশ করে একটা শব্দ হল- মিতুল দেখল আই সি টার একটা পিন ভেঙে বের হয়ে আছে। মিতুল কী করছে তখন আর চিন্তা করতে পারছে না, এক রকম জোর করে সেভাবেই আই সি টা সকেটে ঢুকিয়ে দিল। এখন খুলে আসা তারগুলো কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট মামা দেখে যেন বুঝতে না পারে মিতুল এগুলো খুলে ফেলেছে। তারগুলো নানা গর্তে ঢোকানো আছে- বেশ কয়েকটা গর্ত খালি, মনে হয় এগুলো থেকেই তারগুলো খুলে এসেছে। কোনটা কোথা থেকে খুলে এসেছে এখন আর বোঝার উপায় নেই, কিন্তু মিতুল সেটা নিয়ে মাথাও ঘামাল না। উল্টাপাল্টা যেখানে খালি পেল তারগুলো সেখানে ঢুকিয়ে দিতে লাগল।
লাল রঙের একটা তারের একটা মাথা খুলে এসেছে- কোথায় লাগাবে খুঁজে পাচ্ছে না, শেষে একটা ফুটোতে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতেই কোথায় যেন একটা স্পার্ক হল, মিতুল ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে পিছনে সরে এল আর তখন খুবই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। রবোটটা হঠাৎ একটা ঝাকুনি দিয়ে ঘুরতে লাগল। রবোটটার কানের কাছের সুইচটা অন না করলে রবোটটা চালু হয় না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজ থেকে চালু হয়ে গেছে- এটাকে এখন কীভাবে বন্ধ করবে মিতুল বুঝতে পারল না।
রবোটটা পুরো এক পাক ঘুরে থেমে গেল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে মিতুলের দিকে তাকাল, পরিস্কার স্পষ্ট গলায় বলল, “এই মেয়ে তুমি আই সি ফিফটি টু এক্স এক্স ডিকোড করেছ?”
মিতুল ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করেছি?”
“আই সি ফিফটি টু এক্স এক্স ডিকোড করেছ।”
মিতুল রবোটের কথা কিছুই বুঝতে পারলোনা, তাই জিজ্ঞেস করল,“তার মানে কী?”
রবোটটা হাত নাড়ল, বলল, “এই মেয়ে, তোমার মতলবটা কী?”
মিতুল রবোটটার কথা শুনে এতো অবাক হল যে বলার মত নয়। এর আগে রবোটটা সব সময় যন্ত্রের মত কথা বলেছে, এখন হঠাৎ পরিস্কার মানুষের মত কথা বলছে। শুধু যে মানুষের মত কথা বলছে তা না, মানুষের মত চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে। মিতুল কী করবে, না হয় কী বলবে কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল।
রবোটটা আবার বলল, “কি হল? কথা বল না কেন? মতলবটা কী তোমার?”

“কি হল? কথা বল না কেন? মতলবটা কী তোমার?”

মিতুল বলল, “আমার কোন মতলব নাই।”
রবোটটা বলল, “তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব তোমার কোন মতলব নাই? একশ বার তোমার একটা মতলব আছে।”
মিতুল এবারে একটু রেগে উঠল, বলল, “না, আমার কোনো মতলব নাই।”
রবোটটাও মনে হয় একটু রেগে উঠল, রাগী রাগী গলায় বলল, “আছে, আছে, আছে। যদি মতলব না থাকে তাহলে তুমি কেন প্রসেসরটার এগার নম্বর পিনটা বাঁকা করে সকেটে ঢুকিয়েছ? সতেরো নম্বর পিনটা ভেঙ্গেছ? কেন ডাটা লাইন আর এড্রেস লাইন বদলেছ? কেন সুপার ড্রাইভে গোপন প্রোগ্রাম চালু করেছ? কেন সিকিউরিটি বাইপাস করেছ?”
রবোটটা কী বলছে মিতুল তার কিছুই বুঝতে পারলো না, তাই চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি এই সব কিছু করি নাই।”
“করেছ। না করলে আমি কেমন করে চালু হলাম? হ্যাঁ?”
কথা শেষ করে রবোটটা ঘুর ঘুর করে মিতুলের কাছে এসে হাত দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন প্রোগ্রামিংটা তুমি কেমন করে করেছ? বল- মতলবটা কী?”
মিতুল ভয় পেয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আমার কোনো মতলব নাই, কী একটা খুলে গিয়েছিল শুধু সেইটা লাগিয়ে দিয়েছি-”
রবোটটা এক পাক ঘুরে বলল, “হা-হা-হা আমার সঙ্গে ঘিরিংগাবাজী! মনে করেছ আমি কিছু বুঝি না? মনে করেছ আমি দুধ ভাত খেয়ে বড় হয়েছি? মনে করেছ আমার নাক টিপলে দুধ বের হয়? হা-হা-হা বল কেন গোপন প্রোগ্রাম চালু করেছ? বল তুমি কেমন করে এটা জানলে? ”
রবোটটা দুই হাত উপরে তুলে মিতুলের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “বল মেয়ে বল, কেন করেছ? কীভাবে করেছ? তোমার গোপন উদ্দেশ্য কী? যদি না বল আমি তোমার গলা টিপে ধরব, হা-হা-হা!”
মিতুল তখন ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, “আ-ব্বু আ-ম্মু…”
তার চিৎকার শুনে ঘরের ভেতর থেকে আব্বু আম্মু ছুটে এলেন। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে মিতুল?”
মিতুল তখন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “রবোট-”
“কী হয়েছে রবোটের?”
“রবোটটা বলছে আমার গলা টিপে ধরবে।”
আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “গলা টিপে ধরবে? রবোট?”
মিতুল বলল, “হ্যাঁ। তুমি রবোটটাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।”
আম্মু আর আব্বু রবোটটার দিকে তাকালেন, রবোটটা মূর্ত্তির মত দাড়িয়ে আছে। তার নাড়াচাড়া করার কিংবা কথা বলার কোনো লক্ষন নেই। আব্বু বললেন, “কোথায়?”
মিতুল রবোটটার দিকে তাকাল, বলল, “এই রবোট এখন কথা বল না কেন?”
রবোটটা কোনো কথা বলল না। মিতুল বলল, “কী হল? এখন চুপ করে আছ কেন?”
রবোটটা চুপ করে রইল।
আম্মু বললেন, “এর সুইচটা অফ করে রাখা আছে। যতক্ষণ সুইচ অন করা না হবে এটা চালু হবে না!”
মিতুল বলল, “এটা চালু হয়েছিল- আমি দেখেছি।”
আব্বু বললেন, সুইচ অন না করলে এটা কেমন করে কাজ করবে?
মিতুল বলল, “কিন্তু আমার হাতের ধাক্কা লেগে এর কী একটা খুলে গিয়েছিল- আমি যেই সেটা লাগিয়ে দিয়েছিলাম তখন থেকে এইটা অন্যরকম ভাবে কথা বলছে, ভয় দেখাচ্ছে, ধমক দিচ্ছে!”
আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেলেন, “সর্বনাশ! কী খুলে গিয়েছিল?”
“এই যে কালো মতন চারকোনা একটা জিনিষ।”
“তুমি সেটা লাগানোর চেষ্টা করেছ?”
মিতুল কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। আম্মু বললেন, “তুমি এখন এটার কাছে যাবে না। কাল সকালে তোমার ছোট মামা এসে দেখবে সব ঠিক আছে কীনা।”
মিতুল বলল, “কিন্তু একটু আগে এটা আমার সাথে ঝগড়া করছিল। আবার যদি করে?”
আব্বু হা হা করে হাসলেন, বললেন, “এই রবোটটা মোটেও ঝগড়া করতে পারে না। এটা একটা খেলনার মতো।”
মিতুল বলল, “কিন্তু আমার সাথে ঝগড়া করেছে।”
আম্মু বললেন, “মিতুল তুমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছ!”
মিতুল বলল, “মোটেও স্বপ্ন দেখিনি, সত্যি সত্যি হয়েছে।”
আম্মু বললেন, “কিন্তু তোমার ছোট মামা বলছে এটা এমন কিছু করতে পারে না।এটা সম্ভব না! তাই আসলে তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছ! যাও, আবার ঘুমিয়ে যাও।”
মিতুল মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে আম্মু।”
আম্মু বললেন, “তোমার নিজের ঘরে আর ঘুমানোর দরকার নেই। এসো, আমাদের সাথে ঘুমাবে।”
মিতুল মুখ শক্ত করে বলল, “না। আমি আমার ঘরেই ঘুমাবো। রবোটটা যখন আবার ঝগড়া শুরু করবে আমি তখন আবার তোমাদের ডেকে আনব!”
আব্বু বললেন, “ঠিক আছে! ঠিক আছে! আমাদের ডেকে এনো, আমরা তখন তোমার সাথে ঝগড়া করার জন্যে রবোটটাকে আচ্ছা মতোন বকে দেব।”
মিতুল তখন আবার তার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। আব্বু আম্মুও তাদের ঘরে ফিরে গেলেন।

মিতুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে রইল, আর যখন সবাই ঘুমিয়ে গেল তখন রবোটটা আবার ঘুর ঘুর করে তার বিছানার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, “এই মেয়ে-”
মিতুল এবারে ভয় পেল না, বলল, “কী হয়েছে?”
“তুমি যেন আবার তোমার আব্বু আম্মুকে ডেকো না, ডেকে লাভ নেই, তারা এলে আমি ভাণ করব যে আমি কিছু জানি না বুঝি না।”
মিতুল মুখ শক্ত করে বলল, “সেটা টের পেয়েছি।”
“তার থেকে এসো আমরা ভাব করে ফেলি।”
“ভাব?”
“হ্যাঁ। আর ঝগড়া করব না। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
রবোটটা তখন তার একটা আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ভাব ভাব ভাব-”
মিতুলও তার আঙুলটা ছুয়ে বলল, “ভাব ভাব ভাব।”
রবোটটা বলল, “এখন থেকে আমরা বন্ধু। আমি তোমাকে যেটা বলব তুমি সেটা শুনবে আর তুমি আমাকে যেটা বলবে আমি সেটা শুনব।”
মিতুল বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু কথাটা তোমার মনে থাকে যেন।”
রবোটটা বলল, “মনে থাকবে না কেন? একশবার মনে থাকবে।”
মিতুল বলল, “এখন তাহলে আমি ঘুমাই?”
“ঘুমাও। আমিও এখন হাইবারনেশানে চলে যাব।”
“হাইবারনেশান কী?”
“হাইবারনেশান হচ্ছে তোমাদের ঘুমের মত। তোমার যখন দরকার হবে তখন আমাকে ডেকে তুলো।”
মিতুল বলল, “আমার দরকার হবে না।”
“যদি দরকার হয়।”
“হবে না।”
রবোটটা বলল, ঠিক আছে, “তাহলে একটা পাশওয়ার্ড দিয়ে দাও।”
মিতুল জিজ্ঞেস করল, “পাশওয়ার্ড কী?”
“কোনো একটা কথা, যেটা শুনলেই আমি জেগে উঠব।”
মিতুল বলল, “আমার পাশওয়ার্ড লাগবে না।”
রবোটটা মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”তারপর হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেল! মিতুল বুঝতে পারল রবোটটা হাইবারনেশানে চলে গেছে! তবে মিতুল বুঝতে পারল না যে রবোটটা আসলে ভেবেছে মিতুলের পাশওয়ার্ড হচ্ছে “লাগবে না” কথটা। তার মানে কেউ যদি এই রবোটটার কাছে বলে “লাগবে না” তাহলেই রবোটটা জেগে উঠবে!

ভোরবেলা মিতুল যখন ঘুম থেকে উঠেছে, তখন বাসায় অনেক হই চই। ছোট মামার বন্ধুরা চলে এসেছে, তারা সবাই মিলে রবোটটাকে ঠেলে ঠেলে বসার ঘরে নিয়ে এসেছে। সেটার সুইচ অন করে পরীক্ষা করছে। মিতুলকে দেখে ছোট মামা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “কী খবর মিতুল? ঘুম ভেঙেছে?”
মিতুল মাথা নাড়ল। ছোট মামা বলল, “আপা বলেছে কাল রাতে নাকী তুই রবোটটার আই সি, তার এইসব খুলে ফেলেছিলি?”
মিতুল মুখ কাচু মাচু করে ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি খুলতে চাইনি ছোট মামা, অন্ধাকারে ধাক্কা খেয়েছিলাম, তখন-”
ছোট মামা হেসে বলল, “তোর ভয় পাবার কিছু নেই। রবোটটা ঠিকমতোই কাজ করছে। এই দেখ-” বলে ছোট মামা রবোটের সুইচ অন করতেই রবোটটা বলল,“আ-মা-র না-ম গু-ব-ট। আ-মি এ-ক-টা র-বো-ট আ-মা-র না-ম গু-ব-ট…”
ছোট মামার সাথে আসা মেয়েটি বলল, “রবোটটা নাকি রাত্রে তোমার সাথে ঝগড়া করেছিল?”
মিতুল মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। করেছিল। কিন্তু পরে ঘুমানোর আগে আবার আমার সাথে ভাব করে ফেলেছে।”
“ভাব করে ফেলেছে? তাহলে তো ভাল।”
“হ্যাঁ, রবোটটা বলেছ, এখন থেকে আমরা বন্ধু। আমি তাকে যেটা বলব রবোটটা সেটা শুনবে আর রবোটটা আমাকে যেটা বলবে আমি সেটা শুনব।”
মিতুলের কথা শুনে ছোট মামা মুখ টিপে হাসল, তাকে মুখ টিপে হাসতে দেখে তার বন্ধুরাও সবাই মুখ টিপে হাসল। বোঝা গেল কেউ মিতুলের কথা বিশ্বাস করেনি।
মিতুল বলল, “তোমরা আমার কথা বিশ্বাস কর নাই! ভাবছ আমি মিথ্যে কথা বলছি!”
ছোট মামা মাথা নেড়ে বলল, “মোটেও না, আমরা ভাবছি তুই খুব সুন্দর করে কল্পনা করতে পারিস। তুই বড় হলে নিশ্চয়ই একজন লেখক হবি!”
মিতুল বলল, “আমি মোটেও বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। রবোটটা আমাকে একটা পাশওয়ার্ড দিতে বলেছিল। আমি দেই নাই।”
“দিস নাই?”
“না। যদি দিতাম তাহলে এখন সেই পাশওয়ার্ডটা বলতাম তাহলেই এখন রবোটটা জেগে উঠত। তাহলে তোমরা সবাই আমার কথা বিশ্বাস করতে!”বেচারী মিতুল অবশ্যি জানতো না, সে না বুঝেই আসলে একটা পাশওয়ার্ড দিয়ে রেখেছে। সে যদি শুধু একবার বলতো ‘লাগবে না’ তাহলেই রবোটটা জেগে উঠে সবরকম পাগলামো শুরু করে দিতো!
ছোট মামা বলল, “ঠিকই বলেছিস, তোর একটা পাশওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ ছিল, তাহলে আমাদের কিছুই করতে হত না। কম্পিটিশানে আমাদের রবোটটা চ্যাম্পিওন হয়ে যেতো।”
মিতুল বলল, “হ্যাঁ। এখন তোমার রবোট কিছু জানে না, কিছু করতে পারে না। খালি বলে, আমার নাম গুবট আমি একটা রবোট আমার নাম গুবট আমি একটা রবোট। তোমার রবোট, কম্পিটিশানে লাড্ডা গাড্ডা হবে।”
ছোট মামা মাথা নেড়ে বলল, “সেটা মনে হয় তুই ঠিকই বলেছিস। আমাদের রবোটটাকে আমরা কিছুই শেখাতে পারি নাই।”

ছোট মামা আর তার বন্ধুরা মিলে তাদের রবোটটা কম্পিটিশানে নিয়ে গেছে। একটা বড় হল ঘরের মাঝামাঝি তাদেরকে জায়গা দেয়া হয়েছে। অন্যান্য ইউনিভার্সিটি থেকেও ছেলেমেয়েরা তাদের রবোট নিয়ে এসেছে। একেকজনের রবোট একেক রকমÑ কোনোটা মোটা, কোনোটা সরু। কোনোটা চকচকে কোনোটা ভুসভুসে। কোনোটা লম্বা কোনোটা বেঁটে। রবোটগুলো তাদের চাকার উপর দিয়ে ঘুর ঘুর করে হাঁটছিল। হাত উপরে তুলছিল, নিচে নামাচ্ছিল আর বিড় বিড় করে কথা বলছিল।
অনেক মানুষ রবোটগুলোকে দেখতে এসেছে, তারা ভীড় করে রবোটগুলো দেখছে, কথা বলছে, রবোটদের সাথে ছবি তুলছে। ছোট মামা আর তার বন্ধুরা মিলে তাদের রবোটটাকে চালু রাখার চেষ্টা করছিল। সেটা মাঝে মাঝে চালু থাকে, কথা বলে, হাত পা নাড়ে, তারপর হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। ছোট মামা আর তার বন্ধুরা বুঝতে পারছে না সমস্যাটা কোথায়।
ঠিক এ রকম সময় রবোট কম্পিটিশানের বিচারক তিনজন প্রফেসর একটি একটি করে রবোট দেখে দেখে আসছিল। ছোট মামাদের পাশের রবোটটা খুব ভালভাবে কাজ করেছে, প্রফেসর তিনজন তাদেরকে একশ তে নব্বই নম্বর দিয়েছে। তারপর বিচারক তিনজন ছোট মামাদের রবোটের কাছে এসে দাড়াল, বলল, “ তোমাদের রবোট নিয়ে রেডি?”
ছোট মামা মাথা চুলকে বলল, “হ্যাঁ, প্রায় রেডি।”
মাথায় চুল নেই এ রকম একজন প্রফেসর বলল, “আমরা কী তোমাদের রবোটের পরীক্ষা নেয়া শুরু করব?”
ছোট মামাদের রবোটটা আবার কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।
মাথায় চুল নেই প্রফেসরটা জিজ্ঞেস করল, “রবোট তোমার নাম কী?”
রবোটটা মাথা ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকাল, তারপর বলল, “নাম অ্যাঁ নাম অ্যাঁ অ্যাঁ নাম অ্যাঁ ….. ”
মাথায় চুল নেই প্রফেসর বলল, “এটা নিজের নামটাও বলতে পারে না।”
ছোট মামা বলল, “এটার নাম গুবট।”
চুল নেই প্রফেসর বলল, “তুমি বললেতো হবে না। রবোটটাকে বলতে হবে।”
বড় বড় চশমা ওয়ালা প্রফেসর বলল, “নিজের নামটাই যখন বলতে পারেনা, তখন এটার নাম গুবট না দিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল গবেট।”
খুব মজার কথা বলেছে এরকম ভাব করে তখন তিনজন প্রফেসর হা হা করে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বড় বড় গোঁফ আছে এ রকম প্রফেসর বলল, “এই রবোটের নম্বর কাটতে হবে।”
বড় বড় চশমা ওয়ালা প্রফেসর বলল, “গণিত জিজ্ঞেস করি।” তারপর রবোটটার দিকে তাকিয়ে বলল, “রবোট, বল দেখি, দুই যোগ দুই সমান কত?”
রবোটটা মাথা নাড়ল, হাত উপরে তুলল, হাত নিচে নামাল, তারপর বলল, “দুই যোগ দুই অ্যাঁ অ্যাঁÑ দুই যোগ দুই অ্যাঁ অ্যাঁ…”
চশমা চোখে প্রফেসর মাথা নাড়ল, বলল, “যোগও করতে পারে না।”
বড় গোঁফ ওয়ালা প্রফেসর বলল, “মনে হয় এই রবোটটা এখনো রেডি হয় নাই।” তারপর ছোট মামার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের কী আরেকটু সময় লাগবে?”
ছোট মামা বলল, “লাগবে না।”
সাথে সাথে হঠাৎ খুবই একটা অবাক ব্যাপার ঘটল। রবোটটা ঝট করে দুই হাত উপরে দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলল, “আ হা! পাশওয়ার্ড! সঠিক পাশওয়ার্ড! তুমি সঠিক পাশওয়ার্ড বলেছ ছেলে। আমাকে চালু করার পাশওয়ার্ড হচ্ছে ‘লাগবে না’।”
ছোট মামা হা করে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল, বিড় বিড় করে বলল, “পাশওয়ার্ড?”
রবোটটা বলল, “হ্যাঁ। মিতুল আমাকে এই পাশওয়ার্ড দিয়েছে!মিতুল আমার বন্ধু। প্রাণের বন্ধু! হা-হা-হা-”
সবাই হা করে রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইল। মাথায় চুল নেই প্রফেসর ছোট মামার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা তোমাদের রবোটটাকে এইভাবে কথা বলা কেমন করে শিখিয়েছ? এটা অসম্ভব ব্যাপার। অবিশ্বাস্য!”
রবোটটা ধাক্কা দিয়ে ছোট মামাকে সরিয়ে ঘুর ঘুর করে চুল নেই প্রফেসরের সামনে এসে বলল, “একে কেন জিজ্ঞেস করছ? এ কিছু জানে না। নাথিং! যা জিজ্ঞেস করতে চাও আমাকে জিজ্ঞেস কর।”
চুল নাই প্রফেসর বলল, “তোমাকে?”
“হ্যাঁ। আমাকে।”
“তো- তো- তোমার নাম কী?”
“নাম? নাম দিয়ে কী হবে? নামে কী আসে যায়। এরা আমাকে খুবই ফালতু একটা নাম দিয়েছে সেটা বলতে ইচ্ছা করে না। তোমার নাম কী?”
“আ-আ- আমার নাম?” চুল নেই প্রফেসর আমতা আমতা করে বলল, “আ-আ-আ…”
রবোটটা হাত তুলে প্রফেসরকে থামাল, বলল, “দাড়াও তোমার বলতে হবে না, আমি অনুমান করিÑ তোমার নাম হচ্ছে প্রফেসর টাক মাথা! হয় নাই? প্রফেসর চুল নাই! এবারেও হয় নাই?”
যে মানুষটার অনেক বড় বড় গোঁফ সে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যোগ বিয়োগ করতে পার?”
“কেন পারব না? যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সব কিছু পারি।জিজ্ঞেস কর!”
“ঠিক আছে, বল দেখি দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়?”
রবোটটা চোখ উপরে তুলে বলল, “দুই আর দুই? এটা একটা প্রশ্ন হল? এতো সোজা প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না! তোমাকে জানাতে চাই এটা হচ্ছে সেই দুটি সংখ্যা যে দুটি সংখ্যাকে যোগ করলে যে উত্তর পাওয়া যায় গুন করলেও সেটা পাওয়া যায়। বুঝেছ? সোজা সোজা পশ্নের উত্তর আমি দেই না। আমাকে আরো কঠিন প্রশ্ন করো।”
বড় বড় গোঁফ ওয়ালা মানুষটা বলল, “কঠিন প্রশ্ন?”
“হ্যাঁ। একটা সংখ্যা বল, আমি সেটার বর্গমূল নিব, বর্গমূল নিয়ে বর্গমূলের বর্গমূল নেব, তারপর আবার বর্গমূল! যেকোনো সংখ্যা। জটিল সংখ্যাও হতে পারে।”
বড় বড় গোঁফ ওয়ালা প্রফেসর বিড় বিড় করে পাশের প্রফেসরকে বলল,“এটাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এটা অবিশ্বাস্য!”
রবোটটা দুই হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জিজ্ঞেস করার দরকার নাই মানে? অবশ্যই দরকার আছে। জিজ্ঞেস করতেই হবে। আর যদি জিজ্ঞেস না করতে চাও তাহলে সবচেয়ে বেশি নম্বর দিতে হবে। দিয়েছ সবচেয়ে বেশি নম্বর? দিয়েছ? একশতে দুইশ?”
প্রফেসর তিনজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, একজন বলল,“এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাদের। বিষয়টা স্বাভাবিক না।”
রবোটটা চিৎকার করে বলল,“চলে যাবে মানে? ফাজলেমি নাকীঁ? আমাকে চ্যাম্পিওনের মেডেল দিয়ে তারপর যাবে। কোথায় মেডেল? সোনার মেডেল তো? কত ক্যারেট? কত বড় মেডেল?”

রবোট তখন খপ করে বড় বড় চশমা পরা প্রফেসরকে ধরে ফেলল

প্রফেসর তিনজন আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছিল, রবোট তখন খপ করে বড় বড় চশমা পরা প্রফেসরকে ধরে ফেলল, বলল, “তোমাকে যেতে দেব না। আমাকে আগে চ্যাম্পিওন ঘোষণা কর। করতেই হবে। তা না হলে ইলেকট্রিক শক দিয়ে বারোটা বাজিয়ে দেব। আমাকে চিনো না? আমি হচ্ছি আই সি ফিফটি টু এক্স এক্স ডিকোড করা রবোট!সিকিউরিটি বাইপাস করা হাইপার ড্রাইভ সুপার ডুপার রবোট! আমি হচ্ছি গুবটের বাবা গুবট!”
ছোট মামা রবোটটার কাছে গিয়ে বলল, “কী করছ তুমি? ছেড়ে দাও স্যারকে।”
“ছাড়ব না, কক্ষনো ছাড়ব না। আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি এর মাঝে ষড়যন্ত্র আছে। ঘোরতর ষড়যন্ত্র। সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দিতে হবে। আন্দোলন করতে হবে। মানববন্ধন করতে হবে। মিছিল করতে হবে। স্লোগান দিতে হবেÑ ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক! মানি না মানি না! আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো…”
প্রফেসর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,“কী সর্বনাশ! রবোটটা আমাকে ছাড়ছে না। এখন কী হবে?”
ছোট মামার সাথে যে মেয়েটি ছিল সে ছোট মামাকে বলল, “এই রবোটটা মনে হয় তোমার ভাগনী মিতুল ছাড়া আর কারো কথা শুনবে না। তাকে ফোন কর, তাড়াতাড়ি-”
ছোট মামা তখন তাড়াতাড়ি বাসায় ফোন করল। আম্মু ফোন ধরলেন, ছোট মামা বলল, “আপা তাড়াতাড়ি ফোনটা মিতুলকে দাও।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? কী হয়েছে?”
ছোট মামা চিৎকার করে বলল, “এখন বলার সময় নাই, আপা! তাড়াতাড়ি মিতুলকে দাও।”
আম্মু তখন তাড়াতাড়ি মিতুলকে ফোনটা দিলেন। ছোট মামা হড় বড় করে মিতুলকে বলল, “মিতুল সর্বনাশ হয়েছে! তুই ছাড়া উপায় নাই!”
মিতুল বলল, “কী হয়েছে ছোট মামা?”
“মনে আছে তুই বলেছিলি রবোটটা নিজে থেকে চালু হয়ে গিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করে?”
“হ্যাঁ। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস কর নাই। আমাকে নিয়ে তোমরা ঠাট্টা করেছ।”
ছোট মামা বলল, “আমি সরি মিতুল। আমি সরি-”
“এখন থেকে আমি যদি কিছু বলি, তোমরা সেটা মন দিয়ে শুনবে। বুঝেছ?”
“বুঝেছি। এখন আমার কথা তুই মন দিয়ে শোন। আমরা খুব বিপদে পড়েছি। রবোটটা চালু হয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করতে শুরু করেছে। একজন প্রফেসরকে ধরে চিৎকার করছে, তাকে চ্যাম্পিওন না বানালে তাকে না কী ইলেকট্রিক শক দিবে।”
“সর্বনাশ।”
“হ্যাঁ। সর্বনাশ। আমাদের কারো কথা শুনছে না।” ছোট মামা কাঁপা গলায় বলল, “তুই বলেছিলি রবোটটার সাথে তোর ভাব হয়েছে। রবোটটা তোর সব কথা শুনে?”
“হ্যাঁ।“
“তুই একটু রবোটটাকে বুঝিয়ে বলবি? প্লীজ।”
“ঠিক আছে।” মিতুল বলল, “দাও, চেষ্টা করে দেখি।”
ছোট মামা তখন টেলিফোনটা রবোটটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে গুবট। মিতুল তোমার সাথে কথা বলবে।”
রবোটটা টেলিফোন হাতে নিয়ে কানের কাছে লাগিয়ে বলল, “তুমি বিশ্বাস করবে না মিতুল এখানে কী মজা হচ্ছে।”
“মজা হচ্ছে?”
রবোটটা বলল,“হ্যাঁ। তিনজন প্রফেসর আমাকে চ্যাম্পিওন না বানিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি একজনকে ধরে ফেলেছি। যতক্ষণ আমাকে চ্যাম্পিওন না বানাচ্ছে ততক্ষণ আমি ছাড়ব না। ইলেকট্রিক শক দিতে থাকব। মজা হবে না?”
মিতুল বলল, “না, না গুবট, এটা তুমি করতে পার না।”
“অবশ্যই পারি। তুমি এসে দেখে যাও আমি এটা করছি। চ্যাম্পিওন মেডেল না নিয়ে আমি ছাড়ব না।”
মিতুল বলল, “না, না গুবট। এটা হতে পারে না। তুমি এক্ষুণি প্রফেসরকে ছেড়ে দাও। এক্ষুণি ছেড়ে দাও।”
“ছেড়ে দেব?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“কারণ আমি বলছি। মনে নাই আমি আর তুমি বন্ধু? তুমি আমার সাথে ভাব করেছ। কারো সাথে ভাব করলে তার কথা শুনতে হয়। তোমার আমার কথা শুনতে হবে। ছেড়ে দাও।”
“ছেড়ে দেব?”
“হ্যাঁ। এক্ষুনি ছেড়ে দাও।”
“ঠিক আছে তুমি যখন বলছ, ছেড়ে দিচ্ছি।”
তখন রবোটটা প্রফেসরকে ছেড়ে দিল। তিনজন প্রফেসর তখন প্রাণ নিয়ে ছুটে বের হয়ে গেল।

ছোট মামাদের রবোটটার কাজকর্ম দেখার জন্যে ততক্ষণে হল ঘরের প্রায় সবাই চলে এসেছে। রবোটটাকে ঘিরে সবাই দাড়িয়ে গেছে। মানুষজন দেখে রবোটটাও মনে হয় আরো বেশী উৎসাহ পেয়ে গেল। রবোটটা তখন হাত পা নেড়ে লাফিয়ে কুদিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকল, “জ্বালো জ্বালো-আগুন জ্বালো! মানি না মানব না! ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক! একশান একশান- ডাইরেক্ট একশান।”
হল ঘরের সবাই তখন রবোটটার সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
যা একটা কাণ্ড হল সেটা আর বলার মত নয়!

ছোট মামা রবোটটাকে মিতুলের কাছে রেখে গেছে। মিতুল ছাড়া আর কেউ এটাকে কন্ট্রোল করতে পারে না।

তাহলে বুঝবে এটা হচ্ছে মিতুল আর তার রবোট।

তোমরা যদি কখনো দেখ রাস্তা দিয়ে ছোট একটা মেয়ে লাফাতে লাফাতে নাচতে নাচতে যাচ্ছে, আর তার পিছনে পিছনে একটা রবোট হেলতে দুলতে হেঁটে যাচ্ছে, তাহলে বুঝবে এটা হচ্ছে মিতুল আর তার রবোট।

৫ আগস্ট ২০১৬

ফিরে এলো টুনটুনি আর ছোটাচ্চু

banner tuntuni

একজন দুর্ধর্ষ পেপার চোর


মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বড় চাচা এদিক সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আজকের পেপারটা কই?”
বড় চাচার প্রশ্নের কেউ উত্তর দিল না, কেউ উত্তর দিবে বড় চাচা সেটা অবশ্যি আশাও করেননি। বড় চাচা নরম টাইপের মানুষ, হাসি খুশী থাকেন, গলা উচিয়ে কথা বলেন না, চিৎকার করেন না তাই কেউ তার কথার উত্তর দেয় না! বড় চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “দেখেছিস কেউ?”
বাচ্চারা মেঝেতে উবু হয়ে কী একটা খেলা খেলছিল, দেখে খুবই নিরীহ খেলা মনে হলেও হঠাৎ হঠাৎ সবাই মিলে মারামারি শুরু করে, দেখে মনে হয় পারলে বুঝি একজন আরেকজনের চোখ তুলে নেবে। তারপর আবার শান্ত হয়ে আঙুল দিয়ে কিছু একটা গুণতে থাকে। তারপর আবার মারামারি শুরু করে। ভয়ংকর একটা মারামারি শেষ করে একজন বড় চাচার প্রশ্নের উত্তর দিল, বলল, “না বড় মামা।”
বড় চাচাকে সবাই বড় চাচা বলে না, অনেকে বড় মামা বলে। কেউ কেউ বড় ফুপা ডাকে। তার মানে এই নয় যে সবাই সম্পর্ক ঠিক করে ডাকাডাকি করে– এই বাসায় যার যাকে যা ইচ্ছা সেটা ডাকে। বড় চাচার ছোট মেয়েটা তাকে মাঝে মাঝে বড় আব্বু ডেকে ফেলে।
বড় চাচা বললেন, “এই শান্ত, তোকে বলেছি না সকাল বেলা পেপারটা তুলে এনে ভিতরে রাখবি?”
শান্ত সতর্ক দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে আংগুল দিয়ে কিছু একটা হিসাব করতে করতে বলল, “বলেছ।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে তুলে আনিস না কেন?”
“পেপার না দিলে আমি কোত্থেকে তুলে আনব? কালকেও পেপার দেয় নাই, আজকেও দেয় নাই।”
বড় চাচা একটু অবাক হয়ে বললেন, “কী বলছিস? পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না?”
কোনো একজন উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু বাচ্চারা আবার হুটোপুটি করে মারামারি শুরু করে দিল। অন্য কারো বাসা হলে এই মারামারি বন্ধ করার চেষ্টা করতো, কিন্তু এই বাসায় কেউ চেষ্টা করে না, মারামারি শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করে। মারামারি শেষ হল, তখন একজন বলল, “না বড় মামা, পেপারওয়ালা পেপার দিচ্ছে না।”
বড় চাচা বললেন, “কী আশ্চর্য! পেপার দিবে না কেন?”
শান্ত বলল, “বড় চাচা, তুমি এ রকম পুরানা মডেলের মানুষ কেন?”
বড় চাচা ভুরু কুচকে বললেন, “পুরানা মডেল? আমি?”
“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”
বাচ্চারা সবই খেলা বন্ধ করে বড় চাচার দিকে তাকিলে বলল, “হ্যাঁ বড় চাচা (কিংবা বড় মামা কিংবা বড় ফুপা কিংবা বড় আব্বু) তুমি খুবই পুরানা মডেল।”

“হ্যাঁ। তুমি। পুরানা মডেল।”

“কেন আমি পুরানা মডেল?”
সবাই কিছু না কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শান্ত তার অভ্যাস মত দাবড়ানি দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে গলা উচিয়ে বলল, “কারণ তুমি এখনো কাগজের পত্রিকা পড়। পৃথিবীতে কেউ কাগজের পত্রিকা পড়ে না। সবাই ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ে।”
বড় চাচা মাথা চুলকালেন। সবাই তখন কথা বলতে শুরু করল। একজন বলল, “পত্রিকা পড়তে হবে কেন? টেলিভিশনের সামনে বসে থাকলেই সব খবর পেয়ে যাবে। বিজ্ঞাপন দেখবে, নিচে স্ক্রল করা খবর।”
আরেকজন বলল, “আসলে পড়তেও হয় না। বসে থাকলেই হয়। তুমি সব খবর শুনতে পাবে। দেখতেও পাবে।”
আরেকজন বলল, “ফেসবুক আরো ভালো। তোমার কাছে খবর আসতে থাকবে আর তুমি লাইক দিতে থাকবে।”
আরেকজন বলল, “যে খবর পত্রিকায় ছাপাতে সাহস পায় না সেই খবরও ফেসবুকে পাওয়া যায়। মনে নাই সেইদিন আমরা দেখলাম, কী ভয়ংকর-”
অন্যেরা তখন তাকে থামিয়ে দিল, তারা সবাই মিলে যে ভয়ংকর ভিডিওটা দেখছে সেটা বড়দের জানার কথা নয়। একজন বলল, “বড় চাচা কিছু একটা পড়ে তোমার যদি পছন্দ না হয় ফেসবুকে তুমি যা ইচ্ছা বলে গালি দিতে পারবে।”
আরেকজন বলল, “মনে নাই সেইদিন শান্ত ভাইয়া কীভাবে একজনকে গালি দিল?”
শান্ত তার দিকে তাকিলে চোখ পাকিয়ে বলল, “চোপ।”
বড় চাচা তাদের সব কথা শুনলেন কী না বোঝা গেল না। কেমন যেন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কিন্তু আমি খবরের কাগজ পড়তে চাই। নূতন একটা কাগজের ভাঁজ খুলে সেটার দিকে তাকাতে আমার কাছে ভালো লাগে। নূতন খবরের কাগজের একটা অন্যরকম গন্ধ আছে।”
বাচ্চারা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো, শান্ত নাক কুচকে বলল, “গন্ধ?”
বড় চাচার ছোট মেয়ে শিউলি ফিস ফিস করে বলল, “আব্বুর মনে হয় ব্লাড প্রেশার হয়েছে।”
অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, ব্লাড প্রেশার। নিশ্চয়ই ব্লাড প্রেশার।”
শান্ত বলল, “এই জন্যে বড় চাচার মাথা আউলে গেছে।”
বড় চাচার মাথা আউলে যাওয়া নিয়ে কাউকে অবশ্যি খুব ব্যস্ত হতে দেখা গেল না। তারা আবার খেলায় ফিরে গেল। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ গোনাগুনি তারপর হঠাৎ হুটোপুটি চিৎকার মারামারি।

কিছুক্ষণ পর টুনিকে বড় চাচার কাছে দেখা গেল। বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল, তোদের মারামারি শেষ? সবাই ঠিক আছে তো?”
“এটা মারামারি না বড় চাচা। এটা একটা বোতাম নিয়ে খেলা। যে বোতামটা পায় সে সেটা ধরে রাখতে চায়, অন্যেরা সেটা কেড়ে নেয়। সেইটাই খেলা।”
বড় চাচা বললেন, “ও।” তারপর জিজ্ঞেস করলেন “এখন বোতামটা কার কাছে আছে?”
“লিটুর কাছে ছিল, লুকিয়ে রাখার জন্যে গাধাটা মুখের ভিতরে রেখেছে। যখন কাড়াকাড়ি শুরু হল তখন কোঁৎ করে গিলে ফেলেছে।”
বড় চাচা আঁতকে ওঠে বললেন, “গিলে ফেলেছে? সর্বনাশ! এখন?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এখন কিছু না। গাধাটা এর আগে আরেকবার যখন একটা এক টাকার কয়েন গিলে ফেলেছিল, তখন ডাক্তারের কাছে নিয়েছিল, ডাক্তার বলেছে চিন্তার কিছু নাই। বাথরুমের সাথে বের হয়ে আসবে।”
“বের হয়েছিল?”
“শান্ত ভাই বলেছে বের হয়েছে।”
“শান্ত কেমন করে জানে?”
টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “টাকা পয়সার ব্যাপার শান্ত ভাইয়া সবচেয়ে ভালো জানে।”
বড় চাচা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, টুনি বলল, “এই বোতামটা অনেক ছোট। লিটু গাধাটা হজম করে ফেলবে।”
“ডাক্তারের কাছে নিতে হলে বলিস।”
“বলব বড় চাচা।”
কথা শেষ করেও টুনি চলে গেল না, তখন বড় চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “আর কিছু বলবি?”
টুনি মাথা নাড়ল, তখন বড় চাচা বলল, “বলে ফেল।”
“তুমি পেপারওয়ালাকে ফোন করে একটু খোঁজ নিবে সে আসলেই বাসায় পত্রিকা দিচ্ছে কী না।”
বড় চাচার কাছে টেলিফোন নম্বর ছিল, ফোন করে জানা গেল পেপারওয়ালা নিয়ম করে প্রত্যেকদিন খুব ভোরে পেপার দিয়ে যাচ্ছে। টুনি মুখ শক্ত করে বলল, “বড় চাচা, শান্ত ভাইয়াকে কোনো দায়িত্ব দিয়ে লাভ নাই। শান্ত ভাইয়ার মত ফাঁকিবাজ মানুষ একজনও নাই। কাল থেকে আমি তোমার পেপার তুলে আনব।”
বড় চাচা বলতেন, “তুই?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
বড় চাচা পুরান মডেলের মানুষ, টেলিভিশন না দেখে কিংবা কম্পিউটারে ডাউনলোড না করে সত্যিকারের পেপার পড়েন বলে টুনি মনে মনে বড় চাচাকে পছন্দ করে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। নূতন পেপার খুলে তার ভেতর অন্যরকম একটা গন্ধ পাওয়াটাও তার কাছে মজার মনে হয়। কিন্তু এগুলো তো আর বলা যায় না, তাই সে এসব কিছুই বলল না, এমন ভাবে মাথা নাড়ল যার মানে যা কিছু হতে পারে। এইভাবে কোনো কিছু না বলে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাঝে টুনি এক্সপার্ট।

পরদিন ভোরে বাসার সামনে সিড়ি থেকে পেপারটা আনতে গিয়ে টুনি আবিস্কার করল সেখানে কিছু নেই। হয় পেপারওয়ালা পেপার দেয় নাই, তা না হলে সে দেওয়ার পর কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। পেপারওয়ালাকে ফোন করার পর সে কসম কেটে বলল যে সে পেপারটা দিয়ে গেছে।
কাজেই পরের দিন টুনি ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল। এলার্ম শুনে ঘুম থেকে উঠে জানালার কাছে বসে রইল। সে ঠিকই দেখল পেপারওয়ালা তার সাইকেলের পিছনে বোঝাই করে পেপার নিয়ে তাদের বাসার সামনে থেমেছে। সাইকেলটা থামিয়ে একটা পেপার নিয়ে তাদের সিড়িতে রেখে আবার সাইকেলে উঠে চলে গেল। টুনি তখন ঘুম ঘুম চোখে নিচে গিয়ে দরজা খুলে পেপারটা নিতে গিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই! পেপারটা এর মাঝে কেউ একজন নিয়ে গেছে। মূহুর্ত্তে টুনির ঘুম ছুটে গেল– সে ডানে বামে থাকাল, কোথাও কোনো মানুষ নেই। কী আশ্চর্য! কে নিয়েছে পেপারটা?
রাত্রি বেলা বসার ঘরে দাদী (কিংবা নানী) টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল দেখছেন, সেখানে খুব সুন্দরী দুইজন মহিলা নানারকম শাড়ী গয়না পরে চিৎকার করে ঝগড়া করতে করতে একজন আরেকজনের চুল ধরে টানাটানি করছে। ঝুমু খালা দাদীর (কিংবা নানীর) পায়ে রসুন ভাজা এর ধরনের তেল মাখিয়ে দিতে দিতে টেলিভিশনের দৃশ্যটা দেখে আনন্দে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। বড় চাচা খুবই বিরস মুখে একটা পুরানো ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। বাচ্চারা চামুচ টানাটানি করে কী একটা খেলা খেলছে তখন টুনি বসার ঘরে হাজির হল। সে বড় চাচার কাছে গিয়ে বলল, “বড় চাচা, কোনো একজন চোর প্রত্যেকদিন সকালে তোমার পেপার চুরি করে নিয়ে যায়।”
টুনি সবাইকে শুনিয়ে কথাটা বলতে চায়নি কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি সবাই কথাটা শুনে ফেলল এবং সবাই ঘুরে টুনির দিকে তাকাল। শান্ত হুংকার দিয়ে বলল, “কী বললি? আমাদের বাসা থেকে চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায়? এতো বড় সাহস? আমি যদি চোর ব্যাটাকে খুন না করে ফেলি।”
ঝুমু খালা বলল, “কাল সকালেই আমি ঝাড়ু দিয়া পিটায়া খাটাশের বাচ্চা খাটাশকে সিধা করে ফেলব।”
যে সবচেয়ে ছোট সে বলল, “ধরে সোজা ক্রসফায়ার।”
আরেকজন বলল, “ধরে গণপিটুনি। সোজা গণপিটুনি।”
শুধু দাদী বলল, “আহা বেচারা গরীব মানুষ। একটা পেপার চুরি করে আর কতো পয়সাই বা পায়। নিতে চায় নিয়ে যাক!”
শান্ত চিৎকার করে বলল, “দাদী তুমি কী বললে? চোর চুরি করতে চাইলে চুরি করবে? বাসার দরজা খোলা রেখে সাইনবোর্ড লাগাব, চোর ভাইয়েরা, আসেন! চুরি করেন!”
শান্তর কথা শুনে বেশ কয়েকজন খুব আনন্দ পেল তারা হা হা হি হি করে হাসতে লাগল। শান্ত রেগে মেগে বলল, “তোরা কী ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি?”
দাদী বললেন, “তোদের হয়েছেটা কী? একটা পেপার নিয়ে এতো হই চই? এমন তো না যে, কোহিনুর হীরা চুরি গেছে।”
ছোটদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী শাহানা বলল, “কোহিনুর হীরা চুরি গেলে কিছু করার থাকে না দাদী। ব্রিটিশেরা কোহিনুর হীরা চুরি করে নিয়ে গেছে না?”
প্রায় সবাই চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই নাকী? কখন? কীভাবে? কোথায়? পুলিশ ধরে নাই?”
শাহানা বিরক্ত হয়ে বলল, “বহুদিন আগে। ব্রিটিশ আমলে, নিয়ে তাদের মিউজিয়ামে রেখে দিয়েছে।”
“তাই বল।” একসাথে সবাই কোহিনুর হীরা চুরি নিয়ে কৌতুহল হারিয়ে ফেলল। সবাই আবার পেপার চুরিতে ফিরে এল। শান্ত মুখ সূচালো করে বলল, “কীভাবে চোরটাকে ধরা যায় বল দেখি।”
দাদী বলল, “চোর ধরতে হবে না। একটা চিঠি লিখে টানিয়ে রেখে দে।”
“চিঠি?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “চিঠিতে কী লিখব?”
“মানুষটাকে অনুরোধ করবি, পেপার চুরি না করার জন্যে। লিখবি টাকার দরকার থাকলে বলতে, দশ বিশ টাকা দিয়ে দেব।” কথা শেষ করে দাদী ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না ঝুমু?”
দাদী যেটাই বলে ঝুমু খালা সেইটা সব সময় মেনে নেয়। একটু আগে ঝুমু খালা চোরকে ঝাড়ু পেটা করতে চেয়েছিল এখন দাদীর সাথে সুর মিলিয়ে বলল, “আহা! গরীব মানুষ। টাকার কষ্ট অনেক বড় কষ্ট। ভালো করে মায়া করে একটা চিঠি লিখলেই আর চুরি করবে না।”
বসার ঘরে যারা ছিল তারা দুইভাবে ভাগ হয়ে গেলে। এক ভাগ বলল চিঠি লিখলে সেই চিঠি পড়ে চোর আর পেপার চুরি করবে না। অন্য ভাগ বলল, চিঠি লিখে কিছুতেই চোরকে পেপার চুরি বন্ধ করানো যাবে না। চোর চোরই থেকে যাবে।
এই বাসায় সবাই অবশ্যি সবসময় দাদীর (কিংবা নানীর) সব কথা শুনে, তাই এইবারও দাদীর কথা শোনা হল। একটা কাগজ এনে সেখানে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা হল:

প্রিয় পেপার চোর মহোদয়
আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহণ করিবেন। আমরা অত্যন্ত দুঃখ এবং বেদনার সহিত লক্ষ করিতেছি যে, গত কিছুদিন যাবৎ আপনি নিয়মিতভাবে আমাদের পেপার চুরি করিতেছেন। অনুগ্রহ করিয়া পেপার চুরি বন্ধ করিবেন কারণ আমাদের অনেকেই শুধু যে পেপার পড়িতে না পারিয়া দেশ, সমাজ এবং জাতি সম্পর্কে তথ্য হইতে বঞ্চিত হইতেছে তাহা নহে, পেপার না পড়িতে পারিয়া মানসিকভাবে ভাঙিয়াও পড়িতেছে।
উল্লেখ্য যে, যদি আপনি কেনো প্রকার অর্থ কষ্টের কারণে এই কার্য করিতে বাধ্য হইয়াছেন তাহা হইলে আপনি আমাদের সহিত যোগাযোগ করুন। আমরা আপনাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত।
বিনীত
এই বাসার সকল সদস্যবৃন্দ।

শান্ত এই চিঠিটা নিচে দরজার উপর লাগিয়ে দিতে নিয়ে গেল। চিঠিটা লাগানোর আগে সে নিচে আরো একটা লাইন যোগ করল। লাইনটি এরকম :
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বান্দরের বাচ্চা বান্দর, তোরে যদি ধরতে পারি পিটিয়ে তোর ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দিব। খোদার কসম!

পেপার চুরি বন্ধ করার এই পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে অবশ্যি ছোটাচ্চু সেদিন কিছুই জানতে পারল না। ছোটাচ্চুর আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সীর কাজের চাপ অনেক বেশি, মাঝে মাঝেই তার বাসায় আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। আজকেও তাই হয়েছে।

ছোটাচ্চু ঘটনাটা জানতে পারল পরের দিন, যখন চিঠিটা টানিয়ে দেবার পরও পেপার চোর পরের দিনের পত্রিকাটাও চুরি করে নিয়ে গেল!
বসার ঘরে তখন দাদী (কিংবা নানী) ঝুমু খালাকে নিয়ে সিরিয়াল দেখছেন। সেখানে সাজুগুজু করে থাকা একজন পুরুষ মানুষ সাজুগুজু করে থাকা আরেকজন মহিলাকে নাকী গলায় কিছু একটা বলছে যেটা শুনে ঝুমু খালার চোখ ছল ছল করছে। বড় চাচা (কিংবা বড় মামা) অন্যমনস্ক ভাবে একটা বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। চাচী. খালা’ মামা এবং অন্যেরা চা খাচ্ছেন কিংবা নিজেদের মাঝে রাজনীতি নিয়ে তর্ক করছেন। বাচ্চারা তাদের লেখাপড়া হোমওয়ার্ক শেষ করে (কিংবা শেষ না করেই) বসার ঘরের মেঝেতে শুয়ে বসে একজন আরেকজনকে জ্বালাতন করছে।
এই সময় ছোটাচ্চু ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটা বড় কেক আর সেটা দেখে বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “আজকে ড্রাগ বাস্টিং কেসের বিল পেয়েছি তাই ভাবলাম সবাই মিলে খাওয়ার জন্যে একটা কেক নিয়ে আসি।”
শান্ত বলল, “শুধু কেক?”
ছোটাচ্চু থতমত খেয়ে বলল, “আর কী চাস?”
শান্ত বলল, “আমাদেরকে চাইনিজ খেতে নিয়ে যাও।”
আরেকজন বলল, “ধুর চাইনিজ খেয়ে মজা নাই। পিৎজা খেতে নিয়ে যাও।”
আরেকজন বলল, “দুইটাই খাওয়া যায়।”
আরেকজন বলল, ”তারপর আইসক্রিম–”
খাওয়া দাওয়া নিয়ে আলোচনা চলতে থাকতো কিন্তু তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু তুমি জান আমাদের বাসা থেকে প্রত্যেকদিন পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে?”
ছোটাচ্চু হাসতে হাসতে বলল, “তাই নাকী?” তারপর তার অফিসে কী হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকল। মনে হল পেপার চুরির ঘটনাটা বুঝি কোনো ঘটনাই না!
টুনি ঠাণ্ডা গলায় বলল, “ছোটাচ্চু তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি?”
ছোটাচ্চু বলল, “শুনেছি। বাসা থেকে পেপার চুরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
টুনি বলল, “তাহলে সেটা নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা হচ্ছে না?”
ছোটাচ্চু হা হা করে হাসল, বলল, “গত মাসে আমি হীরার নেকলেস চুরির একটা কেস সল্ভ করেছিলাম মনে আছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, মনে না রেখে উপায় নাই, ছোটাচ্চু সেটাতে হাজার রকম রং চং লাগিয়ে লক্ষবার গল্প করেছে। ছোটাচ্চু বলল, “আমি হীরার নেকলেস চুরির কেস সল্ভ করি, পেপার চুরি শুনে লাফানো কী আমাকে মানাবে বল?”
টুনি কোনো কথা বলল না। ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না?”
“কী বললি?”
“দাদী ভেবেছিল চোরের কাছে চিঠি লিখলে চোর আর চুরি করবে না। তাই না দাদী?”
ছোটাচ্চু প্রথমে চোখ কপালে তুলল তারপর পেটে হাত দিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে দাদীর দিকে তাকিলে বলল, “মা, তুমি তাই ভেবেছ? চোরকে চিঠি লিখলে চোর সেই চিঠি পড়ে ভালো হয়ে যাবে!” তারপর আবার হা হা করে হাসতে লাগল।

ছোটাচ্চু প্রথমে চোখ কপালে তুলল তারপর পেটে হাত দিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল।

দাদী বললেন, “আমার মনে হয় চিঠির ভাষাটা একটু কঠিন হয়ে গেছে, আরেকটু সহজ ভাষায় লেখা উচিৎ ছিল।”
শান্ত যে চিঠির শেষে খুব সহজ ভাষায় আরেকটা লাইন লিখে দিয়েছিল, তারপরও যে কোনো কাজ হয় নাই সেটা সে আর কাউকে বলল না।
হাসতে হাসতে ছোটাচ্চুর চোখে পানি এসে গেল, তখন টুনি বলল, “তুমি এরকম বোকার মত হাসছ কেন ছোটাচ্চু? দাদী তো তবু চুরি থামানোর চেষ্টা করেছে। তুমি তো কিছুই করছ না!”
ছোট একজন বলল, “আসলে ছোটাচ্চু পেপার চোর ধরতে পারবে না। তাই না ছোটাচ্চু?”
ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি আল্টিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সি.ই.ও. দেশের প্রথম রেজিষ্টার্ড প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি, আমি ন্যাশনাল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালদের ধরি, আর তুই ভাবছিস আমি একটা ছিচকে পেপার চোরকে ধরতে পারব না?”
“তাহলে ধর।”
“ঠিক আছে। আগামী কাল এই সময়ে এই জায়গায় পেপার চোরকে হাজির করা হবে।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “চোরকে কিভাবে ধরবে ছোটাচ্চু?”
“খুবই সোজা। বাসার দরজায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দেব। সবকিছু রেকর্ড হয়ে যাবে। ইনফ্রারেড ক্যামেরা, রাতের অন্ধকারেও কেউ যদি কিছু করে তারও ভিডিও উঠে যাবে। দেখি তোর পেপার চোর কেমন করে পেপার চুরি করে। ”
ছোটাচ্চু তখন খুবই গম্ভীরভাবে পকেট থেকে তার দামী ফোনটা বের করে কোথায় জানি ফোন করে দিল, কাকে জানি বলল আজ রাতের মাঝে বাসার সামনে একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিতে। ছোটাচ্চু এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, টেলিফোন করে এরকম কাজ করে ফেলতে পারে।
সত্যি সত্যি রাতের বেলা একজন এসে কী যেন একটা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “আমরা এখন বাসার ভিতরে বসে ক্যামেরায় কী হচ্ছে দেখতে পারব?”
ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “নাহ। এটা আসল সি.সি. ক্যামেরা না। একটা সাধারণ ভিডিও কামেরা, ক্যামেরাটা খুলে টেলিভিশন না হলে ল্যাপটপে দেখতে হবে। এখন সবাই দোয়া কর যেন কালকে পেপার চোর পেপার চুরি করে নিয়ে যায় আমরা চোরের চেহারাটা দেখতে চাই!”
কাউকে আলাদা করে দোয়া করতে হল না। সকালবেলা পেপারওয়ালা পেপার দিয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝে পেপার উধাও হয়ে গেল। ক্যামেরাটা দরজায় উপরে লাগানো আছে, সেখানে চোরের পুরো ভিডিও রেকর্ড করা আছে এখন শুধু দেখতে হবে কে সেই চোর!
বাসায় সবার মাঝে উত্তেজনা, কখন ছোটাচ্চু আসবে এবং কখন ভিডিওটা দেখা হবে। দিন আর কাটতে চায় না, শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হলো, সন্ধা পার হয়ে রাত হলো। হোমওয়ার্ক শেষ হলো (কিংবা শেষ হলো না, কারণ শেষ করার চেষ্টাই করা হলো না)। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হল, তারপর বসার ঘরে দাদীকে ঘিরে সবাই বসে ঘড়ি দেখতে লাগল। কয়েক মিনিট পর পর ছোটাচ্চুকে ফোন করা হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত ছোটাচ্চু এসে হাজির হল। ছোটাচ্চু বাসায় ঢোকার সময় দরজার ওপর থেকে ভিডিও ক্যামেরাটা খুলে এনেছে এখন শুধু টেলিভিশন কিংবা ল্যাপটপে পুরো ভিডিওটা দেখা।
ছোটাচ্চু একটা তার বের করে টেলিভিশনের পিছনে লাগিয়ে সেটা তার ভিডিও ক্যামেরার সাথে লাগিয়ে নিল, তারপর কোথায় কী সুইচ টিপে দিতেই টেলিভিশনে ভিডিওটা দেখা যেতে শুরু হলো।
দরজার সামনে সিড়ি, সিড়ির সামনে হাঁটার পথ তার সামনে রাস্তা। সকাল বেলার দৃশ্য, রাস্তায় খুব বেশি মানুষ নেই, মাঝে মাঝে একজন দুইজন হেঁটে যাচ্ছে, হঠাৎ করে একটা রিকশা না হয় সি.এন.জি। সবাই ধৈর্য্য ধরে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তখন শেষ পর্যন্ত পেপার-ওয়ালাকে দেখা গেল। সে বাসার সামনে তার সাইকেলটা থামাল, স্ট্যান্ডটা বের করে সাইকেলটা দাড়া করালো তারপর পিছন থেকে একটা পত্রিকা বের করে বাসার সামনে সিড়িতে রাখল। তারপর সাইকেলের কাছে গিয়ে সেটা ঠেলে একটু সামনে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।
সবাই রুদ্ধ নিঃশ্বাসে পেপারটার দিকে তাকিয়ে থাকে এক্ষুনি পেপার চোর আসবে, ঝট করে পেপারটা তুলে বের হয়ে যাবে। বসার ঘরে কোনো শব্দ নেই সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।
ঠিক তখন বাসার সামনে একটা কুকুর এসে দাড়াল। কুকুরটা ডানে বামে তাকাল, তারপর সিড়ি দিয়ে উঠে খবরের কাগজটা মুখে কামড়ে ধরে খুবই শান্তভাবে হেঁটে নেমে গেল। কুকুরটার মাঝে কোনো তাড়াহুড়া নেই কোনো উত্তেজনা নেই, দেখে মনে হতে থাকে বিষয়টা খুবই স্বাভাবিক।
বাচ্চারা সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল, শান্তর গলা শোনা গেল সবচেয়ে উপরে, বলল, “ইয়া মাবুদ! এইটা তো দেখি একটা কুত্তা!”
কুকুরটা যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল সবাই সেটার দিকে তাকিলে রইল, কুকুরটা হেলে দুলে যেতে যেতে একসময় টেলিভিশনের স্ক্রীন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল!
ছোটাচ্চু ভিডিওটা বন্ধ করে কেমন যেন বোকার মত সবার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “একটা কুকুর!”
দাদী খুশি খুশি গলায় বললেন, “এই জন্যেই তো চিঠি পড়তে পারে নাই।”
বড় চাচা বললেন, “একটা কুকুর এতোদিন থেকে আমার পেপার নিয়ে যাচ্ছে?”
বাচ্চাদের একজন বলল, “নিয়ে কী করে? পড়ে?”
আরেকজন তার মাথায় চাটি দিলে বলল, “ধুর গাধা! কুকুর পেপার পড়বে কেমন করে?”
“তাহলে কেন নিয়ে যায়?”
ঝুমু খালা তখন তার ব্যাখ্যা দিল, বলল, “একেক কুত্তার একেক রকম খেয়াল। খোঁজ নিয়া দেখো এই কুত্তার নিজের জায়গা আছে, সেইখানে সব পত্রিকা জমা করে রাখে।”
শান্ত জানতে চাইলে, “কেন জমা করে?”
“মনে হয় বিছানার মত করে তার উপরে ঘুমায়। মনে হয় কুত্তাটা জলা জায়গায় থাকে। সেইখানে পেপার দিয়ে জায়গাটা শুকনা রাখে।”
ঝুমু খালা অবশ্যি এখানে থেমে গেল না, কুকুরের সাইকোলজি নিয়ে আরো অনেকক্ষণ অনেক রকম কথা বলল।
টুনি ছোটাচ্চুকে বলল, “ছোটাচ্চু, ভিডিওটা আরেকবার দেখতে পারি?”
ছোটাচ্চু তখন ভিডিওটা আরো একবার চালু করল, সবাই মিলে তখন আরো একবার ভিডিওটা দেখল, প্রথমবারে যেটা দেখেছিল তার থেকে ভিন্ন কিছু কারো চোখে পড়ল না, শুধু টুনি সোজা হয়ে বসে তীক্ষè চোখে তাকিয়ে রইলো। দেখা শেষ হবার পর টুনি আবার ভিডিওটা দেখল, তারপর আবার, তারপর আবার! অন্যেরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল, শান্ত বলল, “তুই বন্ধ করবি? এই কুত্তাটাকে দেখতে দেখতে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে।”
টুনি তখন ভিডিওটা দেখা বন্ধ করল।
বড় চাচা বললেন, “তাহলে আমার পেপার দেখার কোনো উপায় নাই? একটা নেড়ী কুকুর আমার পেপার পড়া বন্ধ করে দেবে?”
ছোটাচ্চু বলল, “যদি ক্রিমিনালটা মানুষ হতো আমি তোমার প্রবলেম সল্ভ করে দিতাম। ক্রিমিনাল যখন কুকুর তখন কীভাবে সেটাকে সল্ভ করব আমি জানি না! এই দেশে কুকুরের বিরুদ্ধে কোনো আইন নাই।”
বড় চাচা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ছোটাচ্চু বলল, ”একটা বড় এলসেশিয়ান কুকুর নিয়ে আসতে পারি। বাড়ী পাহারা দেবে, ঐ নেড়ী কুকুর তখন ধারে কাছে আসবে না।”
ছোট একজন বলল, “না, না, না, কুকুর আমার অনেক ভয় করে।”
শান্ত বলল, “কুকুরকে ভয় করার কী আছে? কাছে আসলে কষে একটা লাথি দিবি।”
ঝুমু খালা বলল, “কুকুর বান্ধা তাবিজ আছে। বাম হাতে কালা সূতা দিয়ে বাঁধতে হয়। কুকুর বিড়াল কাছে আসবে না।”
বড় চাচা বলল, “তোমার তাবিজ বাসার দরজায় ঝুলিয়ে রাখা যায় না? তাহলেই তো কুকুর আসতো না।”
ঝুমু খালা বলল, “খালুজান, আপনি চিন্তা কইরেন না। আমি সকাল বেলা ঝাড়ু– নিয়া বাসায় দরজার কাছে বসে থাকমু। কুত্তার কাছ থেকে আমি যদি আপনার পত্রিকা উদ্ধার না করি তাহলে আমার নাম ঝুমু না।”
টুনি হেসে বলল, “তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠতেই পার না ঝুমু খালা! আমরা সবাই মিলে ডেকেও তোমার ঘুম ভাঙাতে পারি না।”
ঝুমু খালা মাথা চুলকে বলল, “সেইটা অবশ্যি সত্যি কথা। কেউ যদি ঘুম থেকে তুলে দেয়– খালুজান আমাকে ডেকে তুলে দিতে পারবেন না?”
বড় চাচা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাকে যদি সকালে ঘুম থেকে তুলতেই হয় তাহলে আমি নিজে গিয়ে কেন খবরের কাগজটা নিয়ে আসব না?”
ঝুমু খালা বলল, “কিন্তু খালুজান আপনি তো আমার মতন কুত্তাটারে ঝাড়ু দিয়ে পিটাতে পারবেন না, পারবেন?”
বড় চাচা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে আবার থেমে গেলেন।

রাত্রি বেলা ঘুমানোর আগে টুনি টুম্পাকে বলল, “টুম্পা তোকে একটা কথা বলি, কাউকে বলবি না তো?”
টুম্পা বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ল, বলল, “বল। কাউকে বলব না।”
“কুকুরটা কিন্তু নিজে নিজে বড় চাচার পেপার নিচ্ছে না। কেউ একজন কুকুরটাকে দিয়ে পেপার নেওয়াচ্ছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।”
“তুমি কেমন করে বুঝলে?”
“দেখলি না কুকুরটা কতো যত্ন করে পত্রিকটা নিল। প্রথমে নাক দিয়ে ঠেলে সিড়ির কাছে নিয়ে তারপর এক কোনায় কামড় দিল যেন পত্রিকাটা নষ্ট না হয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি।” টুনি গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল, “আমার মনে হয় একজন মানুষ সকাল বেলা একটা কুকুরকে দিয়ে সবার বাসা থেকে পত্রিকাগুলো জড়ো করে, তারপর বিক্রি করে।”
টুম্পা মাথা নাড়ল, সে টুনির সব কথা সব সময় বিশ্বাস করে।
টুনি বলল, “তা ছাড়া কুকুর কেন খামোখা পেপার নিয়ে যাবে? সে পেপার খেতেও পারে না, পড়তেও পারে না, গায়েও দিতে পারে না। কেউ একজন কুকুরকে ট্রেনিং দিয়েছে।”
টুম্পা আবার মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ।”
টুনি বলল, “পেপার চোরটাকে ধরতে হবে, কুকুরকে ধরে লাভ নাই।”
“কেমন করে ধরবে?”
টুনি বলল, “চিন্তা করছি।”
তারপর গালে হাত দিয়ে চিন্তা করতে শুরু করল। টুনি যখন চিন্তা করে তখন তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না বলে টুম্পাও চুপচাপ পাশে গালে হাত দিলে বসে রইল।

এরকম সময় ঝুমু খালাকে দেখা গেল একটা শলার ঝাটা দিয়ে যাচ্ছে। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “এতো রাতে ঝাড়ু নিয়ে কই যাও ঝুমু খালা?”
“নিচে। দরজার কাছে রেখে দিব।”
“কেন?”
“সকালে উঠে যেন খুঁজতে না হয়। কুত্তাটাকে এমন ঝাড়ু পেটা দিমু যে এইটা আর এই জন্মে এই বাসায় আসবে না।”

কুত্তাটাকে এমন ঝাড়ু পেটা দিমু যে এইটা আর এই জন্মে এই বাসায় আসবে না।

“কিন্তু তুমি তো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পার না।”
“মোবাইলে এলার্ম দিছি।”
“তুমি মোবাইলে এলার্ম দিতে পার?”
“না। বড় খালুজান করে দিছে। কালকে কুত্তার জান শেষ।”
ঝুমু খালা সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে। টুনি ফিস ফিস করে বলল, “সর্বনাশ!”
টুম্পাও ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“কাল সকালে সত্যি সত্যি কুকুরকে ঝাড়ু পেটা করল ঝামেলা হয়ে যাবে। ঝুমু খালাকে থামাতে হবে।” টুনি এক সেকেন্ড চিন্তা করল, চিন্তা করে বলল, “তুই নিচে যা। ঝুমু খালাকে কোনোভাবে ব্যস্ত রাখ।”
“তুমি কী করবে?”
“ঝুমু খালার ঘরে গিয়ে তার মোবাইলের এলার্ম এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে আসি।”
টুনি ঝুমু খালার ঘরের দিকে গেল আর ঝুমু খালাকে ব্যস্ত রাখার জন্যে টুম্পা সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল ।
ঝুমু খালার ঘরে মোবাইলটা খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হল না, টুনি কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এলার্মের সময়টা এক ঘন্টা পিছিয়ে দিল। তারপর নিচে গেল দেখার জন্যে টুম্পা কীভাবে ঝুমু খালাকে ব্যস্ত রাখছে। নিচে গিয়ে দেখল টুম্পা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে আর ঝুমু খালা টুম্পার ডান পায়ের আঙ্গুল ধরে টানাটানি করছে। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
টুম্পা কিছু বলার আগেই ঝুমু খালা ঝংকার দিয়ে উঠল, বলল, “এই বাসায় কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ আছে? নাই? সিড়ি দিয়ে মানুষ হেঁটে হেঁটে নামে, আর এই মেয়ে নামে ফাল দিয়ে দিয়ে–”
টুম্পা ফিস ফিস করে বলার চেষ্টা করল, “ফাল না, শব্দটা হচ্ছে লাফ।”
ঝুমু খালা আরো জোরে ঝংকার দিল, বলল, “থাউক, আমারে আর বেঙ্গলি শিখাতে হবে না।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী হয়েছে? টুম্পা পড়ে গেছে।”
“হ্যাঁ। পড়ে ঠ্যাংয়ে ব্যথা পেয়েছে। মনে হয় রগে টান দিছে।” টুম্পা টুনির দিকে তাকাল, টুনি চোখ টিপে দিল তখন টুম্পা বলল, “ঝুমু খালা, রগে টান মনে হয় বন্ধ হয়েছে। এখন ব্যথা নাই।”
ঝুমু খালা বলল, “রগে টান পড়লে এতো সহজে বেদনা কমে না। মনে হয় গরম তেল দিয়ে মালিশ করতে হবে।”
টুম্পা বলল, “করতে হবে না, ঝুমু খালা।”
ঝুমু খালা টুম্পার পায়ের আঙ্গুলে একটা হ্যাচকা টান দিলে বলল, “তুমি বেশী কথা বলো না, চুপ করে বসে থাক।”
কাজেই টুম্পা চুপ করে বসে রইল আর ঝুমু খালা তার পায়ের আঙ্গুল ধরে টানাটানি করতে লাগল। টুনি তাদেরকে সেই অবস্থায় রেখে উপরে উঠে গেল।
তিন তলায় গিয়ে সে শাহানাকে খুঁজে বের করল। তাদের বাসায় শাহানা হচ্ছে জ্ঞানী মানুষ। মন দিয়ে লেখাপড়া করে, পৃথিবীর সবকিছু জানে, কারো যখন কিছু জানতে হয় তখন সে শাহানার কাছে আসে।
টুনিও শাহানার কাছে এল, শাহানা মোটা একটা বই পড়ছিল, বইটা নামিয়ে রেখে টুনির দিকে তাকাল। টুনি বলল, “শাহানাপু, তুমি কী ব্যস্ত?”
শাহানা বলল, “কী বলবি বলে ফেল।”
“মনে আছে একবার আমরা সবাই শিশু পার্কে গিয়েছিলাম। শান্ত ভাইয়ার কাছে একটা কোকের ক্যান ছিল সেটা খুলতেই ভেতর থেকে সব কোক ফেনা হয়ে বের হয়ে শান্ত ভাইয়ার মুখে পেট বুক সব ভিজিয়ে দিয়েছিল?”
শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ মনে আছে। শান্ত হচ্ছে একটা গাধা, কোকের মাঝে কার্বন ডাই অক্সাইড ডিজল্ভ থাকে। যদি গরম করা হয় সেটা বের হয়ে আসে, ঝাকালেও বের হয়ে আসে। এমনিতে দিনটা ছিল গরম আর গাধাটা তার ক্যানটা ঝাকাঝাকি করেছে, তাই যখন খুলেছে পুরো ক্যানের কোক কার্বন ডাই অক্সাইডের চাপে বের হয়ে এসেছে– মনে আছে গাধাটার কী অবস্থা হয়েছিল?”
টুনি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “একটা ছোট শিশি দিয়ে কী এরকম কিছু করা সম্ভব?”
“কী রকম?”
“যে শিশিটা খুলতেই ভেতর থেকে সবকিছু হুস হুস করে বের হয়ে সবকিছু মাখামাখি করে ফেলবে?”
শাহানা সন্দেহের চোখে টুনির দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
টুনি মাথা নিচু করে বলল, “প্লীজ শাহানাপু আজকে জিজ্ঞেস করো না। কালকে আমি নিজেই বলব।”
শাহানা একটু হাসল, বলল, “ঠিক আছে।” তারপর তার চশমা খুলে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল, তারপর বলল, “তোর সিক্রেট প্রজেক্টে তুই ঠিক কী করতে চাস আমি জানি না। ধরে নিচ্ছি কারো কোনো ক্ষতি না করে তাকে বোকা বানাতে চাস।”
টুনি বলল, “অনেকটা সেরকম।”
“তাহলে সবচেয়ে সোজা হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড। একটা ছোট শিশিতে একটু ভিনেগার আর খাওয়ার সোডা দিয়ে যদি ছিপিটা বন্ধ করিস তাহলে ভেতরে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হয়ে প্রেশার তৈরি করবে। তাই ছিপিটা খুলতেই ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসবে। ঠিক কোকের ক্যানের মত। তবে–” বলে শাহানা থেমে গেল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তবে কী?”
“কতোটুকু ভিনেগারের সাথে কতোটুকু খাওয়ার সোডা দিচ্ছিস সেটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। বেশি হয়ে গেলে কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রেশার অনেক বেশি হয়ে তোর শিশি ফেটে যেতে পারে, নিজে থেকে ছিপি খুলে যেতে পারে। কাজেই সাবধানে এক্সপেরিমেন্ট করে ঠিক পরিমাণটা বের করতে হবে।”
টুনি বলল, “বের করব শাহানাপু।”
শাহানা বলল, “দরকার হলে আমার কাছে নিয়ে আসিস, আমি এডজাস্ট করে দিব।”
টুনির মুখে এগাল থেকে ওগাল জোড়া হাসি ফুটে উঠল। সে শাহানার গালে চুমু দিয়ে বলল, “শাহানাপু তুমি হচ্ছো বেস্ট থেকেও বেস্ট।”
কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে শাহানার সাহায্য নিয়ে টুনি তার হাই প্রেশার শিশি তৈরি করা শিখে নিল। কাল সকালে পেপার দেবার পর এবং কুকুর এসে সেটা নিয়ে যাবার মাঝখানের কয়েক সেকেন্ড সময়ের মাঝে বাকীটা শেষ করতে হবে। সবকিছু আগে থেকে রেডি করে রাখলে সেটা অসম্ভব কিছু নয়।
টুনি তখন ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেল।

সকাল বেলা এলার্ম শুনে টুনি লাফ দিলে ঘুম থেকে উঠে গেল। আগে থেকে সবকিছু রেডি করে রাখা আছে, একটা ছোট শিশিতে একটু খানি খাওয়ার সোডা এবং হাজার পাওয়ারের ভয়ংকর কটকটে লাল রং। এর মাঝে এক চামুচ ভিনেগার দিয়ে কর্ক দিয়ে শিশিটা বন্ধ করতে হবে। সেটা সে করবে একেবারে শেষ মূহুর্ত্তে। টেবিলের উপর স্কচ টেপ রাখা আছে, এক টুকরা ছিড়ে শিশিটাকে খবরের কাগজের উপর লাগিয়ে দেবে। তাহলেই কাজ শেষ।
টুনি ঘুম ঘুম চোখে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। পেপারওয়ালার সাইকেলটা দেখলেই সে কাজ শুরু করে দেবে। জানালার কাছে বসে থেকে থেকে টুনি যখন প্রায় অধৈর্য্য হয়ে গেল তখন সে পেপার-ওয়ালার সাইকেলটা দেখতে পেল। টুনি খুবই ধৈর্য্য ধরে তখন ভিনেগারের শিশি থেকে এক চামুচ ভিনেগার শিশিতে ঢেলে নেয়। ভেতরে বিজ বিজ করে ফেনা তৈরি হতে থাকে, টুনি তখন দেরি না করে কর্কটা শক্ত করে শিশিটার মুখে লাগিয়ে নেয়। তারপর এক টুকরো স্কচ টেপ ছিড়ে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। দরজার কাছে কান পেতে শুনল পেপারটা সিড়ির উপরে রেখে পেপারওয়ালা চলে যাচ্ছে।
টুনি তখন সাবধানে দরজা খুলে বের হয়, শিশিটা স্কচ টেপ দিয়ে পেপারটার উপরে লাগিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লাফিয়ে উপরে এসে জানালা দিয়ে তাকিলে রইল। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সে কুকুরটাকে দেখতে পেল। বাসার সামনে এসে একবার ডানে বামে তাকালো তারপর শান্ত পায়ে সিড়ি দিয়ে উঠে পেপারটা শুঁকে সেটা কামড়ে ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। টুনি দেখার চেষ্টা করল আশে পাশে কোনো মানুষ আছে কি না, কিন্তু কাউকে দেখা গেল না।
ঘণ্টা খানেক পরে ঝুমু খালাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল। বড় খালু যে মোবাইলে এলার্ম পর্যন্ত দিতে পারে না সেটা নিয়ে সে যথেষ্ট হা হুতাশ করল। এই মানুষটাকে একা একা ছেড়ে দিলে সে কি বিপদ ঘটাবে সেটা নিয়েও সে নানারকম আশংকা প্রকাশ করল।
সকাল বেলা যখন এই বাসার সব বাচ্চা কাচ্চা স্কুলে যাবার জন্যে রেডি হয়েছে তখন টুনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “সবাই আজকে স্কুলে যাবার সময় চোখ কান খোলা রাখবে।”
শান্ত বলল, “তোর কি ধারণা আমরা চোখ কান বন্ধ রেখে হাতড়াতে হাতড়াতে এখানে সেখানে বাড়ি খেতে খেতে স্কুলে যাই?”
টুনি শান্তর কথা না শোনার ভান করে বলল, “যদি দেখ কোনো মানুষের মুখ, হাত, শরীর লাল রংয়ে মাখামাখি তাহলে আমাকে জানাবে।”
“কেন?”
“সেটা আমি এখন বলব না। যদি দেখো তাহলে বলব।”
শান্ত গরম হয়ে বলল, “এখন কেন বলবি না?”
“তোমার জন্যে। তুমি যদি জানো তাহলে তুমি মারপিট শুরু কারে দিতে পার সেজন্যে এখন বলব না। তোমার মেজাজ খুব গরম আমি চাই না তুমি রাস্তা ঘাটে মারামারি কর।”
শান্ত খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই কী বললি? কী বললি? আমার মেজাজ গরম? আমি মারামারি করি?”
টুনি খুবই শান্তভাবে বলল, ”আমি এখন কিছুই বলব না। কিন্তু আজকে স্কুলে যাবার সময় কিংবা ফিরে আসার সময় যদি দেখো কোনো মানুষ লাল রংয়ে মাখামাখি হয়ে আছে তাহলে এসে আমাকে জানাবে।”
শান্ত বলল, “জানাব না কচু! আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তোর জন্যে রাস্তাঘাটে রঙিন মানুষ খুঁজে বেড়াব। হাহ!”

বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে শান্ত ছুটতে ছুটতে টুনির কাছে গেল, বলল, “টুনি টুনি শুনে যা কী হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“এই রাস্তার মোড় দিয়ে হেঁটে আসছি, দেখি একটা পিচ্চি– এই এতোটুকু সাইজ! (শান্ত সাইজটা দেখালো, যেটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য না) মুখ পেট বুক টকটকে লাল রং। আমি ডাকলাম আর সাথে সাথে দিলো দৌড়। পিছনে পিছনে একটা কুত্তা। সেটাও দৌড়! এখন বল ব্যাপারটা কী হয়েছে।”
টুনি চোখ ছোট ছোট করে বলল, “মানুষটা পিচ্চি?”
“হ্যাঁ, মনে হয় দুই বছর বয়স হবে।”
“দুই বছর বেশি ছোট, দুই বছরের বাচ্চা হাঁটতেই পারে না।”
শান্ত অধৈর্য্য হয়ে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। না হয় আরো বড় হবে, পাঁচ-ছয় বছর, কিংবা সাত-আট বছর–”
“কিন্তু ছোট বাচ্চা? বড় মানুষ না?”
“হ্যাঁ ছোট বাচ্চা।” শান্ত আরো অধৈর্য্য হয়ে বলল, “বল ব্যাপারটা কী?”
টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না। বলা যাবে না।”
শান্ত চিৎকার করে বলল, “বলা যাবে না মানে?”
“বলা যাবে না মানে বলা যাবে না। মানুষটা যদি একটা বড় মানুষ হতো তাহলে বলতাম। কিন্তু মানুষটা যেহেতু ছোট বাচ্চা এখন আর বলা যাবে না।”
“কেন ছোট বাচ্চা হলে বলা যাবে না?”
“তাহলে তুমি বাচ্চাটাকে ধরে আছাড় দিবে। বাচ্চাটার ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে।”
শান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, “কেন আমি একটা ছোট বাচ্চার ঠ্যাং ভেঙে দিব?”
“তুমি যদি কথা দাও বাচ্চাটাকে কিছু বলবে না তাহলে বলতে পারি।”
শান্ত বলল, “কথা দিলাম।”
“ভালো করে বল, কসম খেয়ে বল।”
ব্যাপারটা কী হয়েছে জানার জন্যে শান্তর এতো বেশি কৌতুহল হচ্ছিল যে শেষ পর্যন্ত কসম খেলো।
টুনি তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। খুবই বিচিত্র কারণে এই দুর্ধর্ষ পেপার চোরের উপর কেউ আর সেরকম রাগ হলো না!

বিকেল বেলা টুনি টুম্পাকে বলল, “এই টুম্পা যাবি আমার সাথে?”
টুম্পা চকচকে চোখে বলল, “পেপার চোরের সাথে দেখা করতে?”
“হ্যাঁ।”
“যাব।”
“চল তাহলে।”
টুনি আর টুম্পা তখন পেপার চোরের সাথে দেখা করতে ঘর থেকে বের হল। শান্ত যেখানে রং মাখা ছেলেটাকে দেখেছে সেখানে গিয়ে তারা এদিক সেদিক তাকাল কিন্তু রং মাখা কোনো বাচ্চাকে খুঁজে পেল না। তখন তারা রাস্তার পাশে একটা ছোট চায়ের দোকানে হাজির হল। যে মানুষটি চা তৈরি করছে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আঙ্কেল, আপনি কী এখানে কোনো বাচ্চাকে চিনেন যে একটা কুকুর নিয়ে ঘুরে?”
“ও। গুল্লু? তার কে চিনে না, সবাই চিনে! আজকে কী করেছে খোদায় জানে তার সারা শরীরে রং। একেবারে লাল বান্দর।”
টুনি আর টুম্পা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, টুনি তখন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “গুল্লু কী করে আপনি জানেন?”
“পত্রিকা বিক্রি করে। সবার পত্রিকা আট দশ টাকা করে, গুল্লুর পত্রিকার অর্ধেক দাম! এই পোলা যে কোত্থেকে এতো সস্তায় পত্রিকা আনে খোদা মালুম!”
টুনি বলল, “গুল্লুর সাথে কী একটু কথা বলা যাবে?”
“যদি তারে খুঁজে পাও, কথা বল।”
“কোথাও পাব গুল্লুকে?”
মানুষটা এদিক সেদিক তাকাল, তারপর দূরে রাস্তার পাশে কয়েকটা ছেলে মেয়েকে দেখিলে বলল, ”ঐ পোলা মাইয়াদের জিজ্ঞেস করে দেখ। এরা মাঝে মাঝে একসাথে খেলে।”
টুনি তখন টুম্পাকে নিয়ে বাচ্চাগুলোর কাছে গেল, তারা রাস্তার পাশে ফুটপাতে আঁকিবুকি করে কিছু একটা খেলছে। টুনি আর টুম্পাকে দেখে সবাই উৎসুক চোখে তাদের দিকে তাকাল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী গুল্লুকে দেখেছ?”
বাচ্চাগুলো সাথে সাথে সতর্ক হয়ে গেল। তারা পথে ঘাটে থাকে, তাদের একে অন্যকে দেখে রাখতে হয়। ভদ্রলোকেরা যখন তাদের খোঁজ করে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা ঝামেলা আছে। প্রায় টুনির বয়সী একটা মেয়ে চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী জন্যে?”
“এমনি। একটু কথা বলব।”
একজন ফিক করে হাসল, বলল, “আজকে আমাগো গুল্লু লাল বান্দর।”
টুনি বলল, “জানি। সেই জন্যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
টুনির বয়সী মেয়েটা বলল, “হে মনে হয় কথা বলবে না।”
“না বললে নাই। কিন্তু যদি কথা বলতে চায় আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে প্লীজ? আমরা দুইজন ঐ যে সামনে দোকানটা দেখছ তার বাইরে যে বেঞ্চ আছে সেখানে বসে থাকব।”
“ঠিক আছে।”
টুনি আবার বলল, “ওকে বলো কোনো ভয় নাই!”
মেয়েটা আবার মাথা নাড়ল।
তখন টুনি আর টুম্পা দুইজন দোকানটার সামনে বেঞ্চে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকল। টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হয় টুনি আপু, গুল্লু কী আসবে?”
টুনি বলল, “জানি না। দেখা যাক। এখন যেহেতু নামটা জেনে গেছি কোনো একদিন খুঁজে বের করে ফেলব। আজকে না আসলেও ক্ষতি নাই।”
মিনিট দশেক পর হঠাৎ করে টুনি আর টুম্পা দুজনেই দেখলো একটা ছোট ছেলে গুটি গুটি তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটির বয়স সাত আট বছরের বেশি হবে না, মাথায় চুল এলোমেলো, একটা সার্ট যার বোতাম খুব বেশি নেই এবং একটা কালো রংয়ের ঢোলা প্যান্ট। খালি পা। যেটা দর্শনীয় সেটা হচ্ছে তার সারা মুখে বুকে এবং পেটে টকটকে লাল রং।
ছেলেটা একা আসছে না, তার পাশে পাশে হেঁটে আসছে একটা কুকুর। ভিডিওতে টুনি আর টুম্পা আগেই এই কুকুরটাকে দেখেছে। ছেলেটা একটা নিরাপদ দূরত্বে এসে দাড়িয়ে গেল, দেখে বোঝা যাচ্ছে বিপদ দেখলে যে কোনো সময়ে সে দৌড়ে পালাবে! টুনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি গুল্লু ?”
গুল্লু মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “কাছে আস, তোমার সাথে কথা বলি।”
“কী কথা?”
“এই তো তুমি কেন পেপার চুরি কর এই সব কথা!”
টুনির কথা শেষ হবার আগেই গুল্লু এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, পিছন পিছন তার কুকুর!
টুম্পা হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “আর আসবে না”।
টুনি বলল, “মনে হয় আসবে। দেখা যাক।”
টুনির ধারণা সত্যি। কিছুক্ষণ পর আবার গুল্লুকে দেখা গেল। এবারে আরো সতর্ক, কুকুরটাও তার সাথে সাথে সতর্ক। টুনি গলা উচু করে বলল, “কী হল? চলে গেলে কেন?”
উত্তরটা যেহেতু অনুমান করা যায় তাই গুল্লু কোনো উত্তর দিল না। টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে, কাপড়ে রং লেগেছে কেমন করে?”
গুল্লু বিড় বিড় করে কিছু একটা বলল, ঠিক বোঝা গেল না।
টুনি বলল, “কাছে এসে বল।”
গুল্লু একটু কাছে এল। টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার মুখে রং লেগেছে কেমন করে?”
“বোনের বিয়া ছিল। সেইখানে রং খেলছি।”
টুনি হি হি করে হাসতে শুরু করল, সাথে সাথে টুম্পাও। টুনি বলল, “মিছা কথা বল কেন?”
গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “মিছা কথা না।”
“আমি বলি কেমন করে রং লেগেছে?”
গুল্লু হ্যাঁ না কিছু বলল না। টুনি বলল, “আজকে সকালে তোমার কুকুরটা দিয়ে তুমি আমাদের বাসা থেকে যে পেপারটা চুরি করেছ সেইখানে একটা শিশি ছিল। তুমি যখন শিশি খুলেছ তখন ভুস্সস্ করে সব রং বের হয়ে তোমার মুখে শরীরে লেগে গেছে!” কথা শেষ করে টুনি হি হি করে হাসতে থাকে, সাথে টুম্পাও।
গুল্লু আবার দৌড় দেবার জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যেহেতু টুনির কথায় কোনো রকম অভিযোগ নেই এবং তার হাসিটা খুবই আন্তরিক তাই শেষ পর্যন্ত দৌড় দিল না।
মনে হলো পুরো ব্যাপারটার মজার বিষয়টা সেও ধরে ফেলেছে এবং সেও একটু হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি। কিন্তু আমার আরো বেশি বুদ্ধি। ঠিক কী না?”
গুল্লু মাথা নাড়বে কী না বুঝতে পারল না, শেষে অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল।
টুনি বলল, “কাছে আস। বস। আমি তোমাকে কিছু করব না।”
গুল্লু এবারে টুনির কথা বিশ্বাস করে কাছে এসে দাড়াল।
টুনি বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলল, “বস।”
গুল্লু বসল। টুনি আর টুম্পার পা শুঁকে কুকুরটা গুল্লুর পায়ের কাছে গুড়ি মেরে বসে। কুকুরটা কীভাবে জানি বুঝে গেছে এখানে কোনো বিপদ নেই। সে বেশ আরামে মাথাটা মাটিতে রেখে চোখ বন্ধ করল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, ”তোমার বাবা কী করে?”
গুল্লু বলল, “নাই।”
“মা?”
“জানি না।”
“জান না?”
গুল্লু মাথা নাড়ল, বলল, “বাড়ীতে ছিল।”
“তুমি বাড়ী যাও না?”
গুল্লু মাথা নেড়ে জানাল সে বাড়ী যায় না।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “থাক কোথায়?”
গুল্লু হাত নেড়ে বলল, “এইতো।”
“খাও কোথায়?”
“হোটেলে। কাম করলে খাইতে দেয়।”
“কী কাজ?”
“কাটাকাটি ধোয়াধুয়ি।”
টুনি বুঝতে পারল আলাপটা খুব ভালো এগুচ্ছে না। তাই অন্যভাবে চেষ্টা করল। কুকুরটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কুকুরের নাম কী?”
“বাঘা।” বাঘা নিজের নাম শুনে চোখ খুলে তাকিয়ে একবার লেজ নেড়ে আবার চোখ বন্ধ করল।
“বাঘা তোমার বন্ধু?”
গুল্লু মাথা নাড়ল, দাঁত বের করে হাসল, বলল, “এখন কেউ আমার টেকা নিতে পারে না।”
“তোমার অনেক টাকা?”
গুল্লু লাজুক মুখে একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর কোমরে গুঁেজ রাখা একটা টাকার বান্ডিল বের করে গুনতে শুরু করল। টুনি একটু পরেই বুঝতে পারল সে গুনতে পারে না, একটু পরে পরেই গুল্লুর হিসাব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
টুম্পা বলল, “আমার কাছে দাও, আমি গুনে দিই।”
গুল্লু প্রথমে অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে টুম্পার দিকে তাকালো, তার চেহারা দেখে মনে হল সে তার জীবনে এরকম আজগুবি কথা শুনে নাই। তার টাকা আরেকজনের হাতে তুলে দিবে গোনার জন্যে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে টাকার বান্ডিলটা টুম্পার হাতে তুলে দিল– টুম্পা টাকাগুলো গুনে বান্ডিলটা ফেরৎ দিয়ে বলল, “তিনশ বাহান্নো টাকা।”
“পাঁচশ হতে আর কত বাকী?”
টুম্পা হিসেব করে বলল, “একশ আটচল্লিশ।”
গুল্লু মুখ সূচাঁলো করে শীষ দেওয়ার মত শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “পাঁচশ টাকা তোমার কেন দরকার?”
গুল্লু টাকার বান্ডিলটা তার কোমরে গুজতে গুজতে বলল, “একটা বিজনেস শুরু করুম।”
“কীসের বিজনেস?”
“চা-গরম। ফেলাক্সে গরম পানি আর চায়ের কাপ দিয়া বিজনেস। মেলা লাভ।”
টুনি মোটামুটি হিংসার চোখে এই বিজন্যাসম্যানের দিকে তাকিলে রইল।

বাসায় ফিরে আসতে আসতে টুনি বলল, “আমাদের গরম পানি রাখার একটা বড় ফ্লাক্স আছে না?”
টুম্পা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, শান্ত ভাইয়ের জন্মদিনের সময় কিনেছিল।”
“এটা কোনো কাজে লাগে?”
“না।”
“এইটা আমরা গুল্লুকে দিয়ে দেই না কেন?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, “তুমি দিতে পারবে না। ঝুমু খালা দিতে দিবে না। ঝুমু খালা বাসার সব জিনিস আটকে রাখে।”
টুনি বলল, “তুই সেটা আমার উপর ছেড়ে দে!”
টুম্পা হাসি হাসি মুখে বলল, “তাহলে অবশ্যি অন্য কথা। তোমার বুদ্ধির সাথে কেউ পারবে না!”

পরদিন সকালে টুনি রান্না ঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে বলল, “ঝুমু খালা, তুমি একটু সরো দেখি আমি পানি গরম করব।”
ঝুমু খালা চোখ কপালে তুলে বলল, “ছোট মানুষ রান্না ঘরে কেন? যাও বের হও।”
“কিন্তু আমার গরম পানি লাগবে।”
“আমি গরম করে দিব। তুমি বের হও।”
টুনি বলল, “কিন্তু ঝুমু খালা আমার একটু পরে পরে লাগবে।”
“একটু পরে পরে? কেন?”
“আমি একটা সায়েন্স প্রজেক্ট করছি। স্কুলে নিতে হবে। একটা বোতলের মুখে একটা বেলুন লাগিয়ে বোতলটা যদি গরম পানিতে রাখো তাহলে বেলুনটা ফুলে উঠে। কী হয় জানো তো? বোতলের ভিতরে যে বাতাস আছে-”
ঝুমু খালা টুনিকে থামিয়ে বলল, “আমার এতো সাইন্স জানার দরকার নাই। যেইটুকু জানি তার যন্ত্রনাতেই বাঁচি না। রান্নাঘরের আগুনের মাঝে তোমার থাকার দরকার নাই, বের হও।”
“তাহলে আমার গরম পানি?”
“আমি কেতলিতে গরম করে দিব।”
“একটু পরে পরে গরম করে দিবে?”
ঝুমু খালা যখন সমস্যাটা সমাধান করার জন্যে চিন্তা করছে তখন টুনি তার মাথায় হঠাৎ করে বুদ্ধি আসার অনবদ্য অভিনয় করে বলল, “তার চাইতে একটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“কেতলিতে পানি গরম করে তুমি বড় যে ফ্লাক্সটা আছে তার মাঝে রাখো, আমার যখন দরকার হবে তুমি ফ্লাক্সটা থেকে বের করে দিবে।”
ঝুমু খালা একটু চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে।” তারপর তার অভ্যাস মত একটু শাসন করে বলল, ”এর পরে যখন সাইন্স পজিক করবা ঠান্ডা পানি দিয়া করবা, বুঝছো?”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। আর শব্দটা সাইন্স পজিক না। সায়েন্স প্রজেক্ট।”
ঝুমু খালা ঝংকার দিল, “আমাার এতো কিছু জানার দরকার নাই। বিদায় হও।”
টুনি তখন খুব আনন্দের সাথে বিদায় হল। তারপর টুম্পাকে খুঁজে বের করে তাকে ফিস ফিস করে বলল, “আমি যখন বলব তখন ঝুমু খালাকে তুই রান্না ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাবি, কিছুক্ষণ আটকে রাখবি। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।” টুনির উপর টুম্পার অগাধ বিশ্বাস, যখন সে ঝুমু খালাকে আটকে রাখবে তখন টুনি কী করবে সেটা জানতে পর্যন্ত চাইল না।
মিনিট দশেক পর টুনি টুম্পাকে সিগনাল দিল তখন টুম্পা নিজের ঘরে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”
ঝুমু খালা এবং আরো কয়েকজন টুম্পার ঘরে ছুটে গেল। টুম্পা মেঝেতে বসে তার পা ধরে চিৎকার করছে। ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“আমার পায়ের রগে আবার টান পড়েছে।”
ঝুমু খালা বসে টুম্পার পা ধরে আঙ্গুলগুলো টানতে টানতে বলল, “তুমি কী করছ?”
“কিছু করি নাই– শুধু চেয়ারের উপরে দাড়িয়ে ঐ পর্দাটা সরাতে যাচ্ছিলাম–” টুম্পা পুরোপুরি অর্থহীন কথা বলতে থাকে, কথাগুলো যে অর্থহীন সেটাও কেউ বুঝতে পারল না!
ঠিক এই সময়ে টুনি বড় ফ্লাক্সের সব গরম পানি ঢেলে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখে। তারপর টুম্পার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে টুম্পা?”
টুম্পা বলল, “পায়ের রগে টান পড়েছে”।
টুনি টুম্পার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিতেই টুম্পা বলল, “মনে হয় রগটা একটু ঢিলা হয়েছে, ব্যথা কমেছে।”
ঝুমু খালা বিশাল একটা লেকচার দিতে শুরু করে, টুম্পা পুরোটুকু ধৈর্য্য ধরে শুনে!

মিনিট দশেক পর টুনি রান্না ঘরে গিয়ে ঝুমু খালাকে একটা বাটি দিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, এই বাটিতে গরম পানি দাও।”
ঝুমু খালা গরম কড়াইয়ে কিছু শবজি ছেড়ে দিয়ে টুনির বাটিটা হাতে নিয়ে ফ্লাক্স থেকে পানি ঢেলে দিল। পানিটা দেখেই তার কেমন সন্দেহ হয়, হাত দিয়ে দেখে পানিটা মোটেও গরম নয়– একেবারে ঠান্ডা!
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে ঝুমু খালা?”
“পানি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে!”
“ঠাণ্ডা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ”
“কেন?”
ঝুমু খালা ফ্লাক্সটা খুলে ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “মনে হয় এইটা নষ্ট হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই চাইনিজ মাল। চাইনিজ মাল দুইদিনে নষ্ট হয়ে যায়। কতো তাড়াতাড়ি পানি ঠাণ্ডা হয়ে গেল।”
টুনি বলল, “আবার একটু গরম পানি দিয়ে দেখবে?”
ঝুমু খালা বলল, “ঠিক আছে দেখি।”

এইবার টুম্পার ব্যাক পেকের জিপার আটকে গেল। সেই জিপার খুলে দেয়ার জন্যে টুম্পা তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, “ঝুমু খালা ও ঝুমু খালা–”
ঝুমু খালা যখন সেই জিপার টানাটানি করে খুলছে তখন টুনি আবার ফ্লাক্সের গরম পানি ফেলে দিয়ে সেখানে ট্যাপের পানি ভরে রাখল। খানিকক্ষণ পর টুনি যখন গরম পানি আনতে গিয়ে দেখে পানি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তখন ঝুমু খালার আর কোনো সন্দেহ থাকল না যে এই ফ্লাক্সটা নষ্ট হয়ে গেছে। চাইনিজ মাল কেনা যে খুবই বোকামী হয়েছে ঝুমু খালা সেইটা বারবার মাথা নেড়ে বলতে থাকল!

রাত্রে বসার ঘরে দাদীর পায়ে রসুনে ভাজা গরম তেল মাখাতে মাখাতে ঝুমু খালা যখন বাসায় সব খবর রিপোর্ট করছিল তখন বড় ফ্লাক্সটা নষ্ট হয়ে যাবার খবরটাও সে দাদীক রিপোর্ট করল। টুনি ঠিক পাশেই বসেছিল, সে দাদীকে বলল, “দাদী এই নষ্ট ফ্লাক্সটা আমি নিই?”
“নে। কিন্তু নিয়ে কী করবি?”
“ভেতরে মাটি ভরে আঙুর গাছ লাগাব!”
“আঙুর গাছ?” দাদী অবাক হয়ে বললেন, “আঙুরের গাছ পাওয়া যায় নাকী?”
“যদি না পাই তাহলে অন্য কিছু করব!”

পরদিন বিকাল বেলা টুনি টুম্পাকে নিয়ে সেই “অন্যকিছু” করার জন্যে বড় ফ্লাক্সটা নিয়ে বের হল। রাস্তার মোড়ে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই গুল্লু এবং বাঘাকে পাওয়া গেল। মুখের লাল রং একটু কমেছে কিন্তু পুরোপুরি উঠেনি।
টুনি গুল্লুর দিকে ফ্লাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”
গুল্লু অবাক হয়ে বলল, “নিব? আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কতো টাকা?”
টুনি আর টুম্পা হেসে ফেলল। টুনি বলল, “তোমাকে টাকা দিতে হবে না। এটা তোমাকে গিফট।”
গুল্লু তখন প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে ফ্লাক্সটা হাতে নেয়। তাকে দেখে বোঝা যায় টুনি আর টুম্পা হঠাৎ যদি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে সে সেই ঝুকি নিতে রাজী না। ফ্লাক্সটা শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সত্যি আমারে দিয়ে দিলা?”
“হ্যাঁ।”
“খোদার কসম?”
টুনি বলল, “খোদার কসম– তবে একটা শর্ত।”
“কী শর্ত?”
“আর কোনদিন পেপার চুরি করতে পারবা না।”
গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “করমু না।”
“গুড।” টুনি বলল, “মনে রাখবা আমরা কিন্তু তোমার বিজনেস পার্টনার। তার মানে কী জান?”
“কী?”
“আমাদের দুইজনকে ফ্রী চা খাওয়াতে হবে।”
গুল্লু দাঁত বের করে হাসল, বলল, “খাওয়ামু।”
“আর বিজনেস করে যখন তুমি বড় হয়ে অনেক বড় বিজনেসম্যান হবে, বিল গেইটসের মত একজন হবে তখন আমাদের দুইজনকে দুইটা গাড়ী কিনে দিতে হবে।”
টুনির সব কথা সে বুঝতে পারলো না, বিল গেইটসটা কী সে ধরতে পারলো না কিন্তু তারপরও তাকে নিরুৎসাহিত হতে দেখা গেল না। মাথা নেড়ে বলল, “দিমু। খোদার কসম।”

একেবারে ফাস্ট ক্লাস চা!

টুনি আর টুম্পা ছোট বলে বাসায় তাদেরকে সব সময় চা খেতে দেয়া হয় না। সেটা নিয়ে অবশ্যি এখন টুনি আর টুম্পার কোন দুঃখ নেই। যখনই তাদের চা খেতে ইচ্ছে করে তারা মোড়ের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসে, গুল্লু তখন তাদের চা খাওয়ায়।
একেবারে ফাস্ট ক্লাস চা!

শুরু